• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ০৬:২৪ পূর্বাহ্ন

তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী : শিষ্যের চাঁদায় গুরু মার বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি


প্রকাশের সময় : মে ২৩, ২০২৩, ১১:১০ পূর্বাহ্ন / ১৬৬
তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী : শিষ্যের চাঁদায় গুরু মার বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি

এম রাসেল সরকারঃ পথে-ঘাটে,পার্কে, ট্রাফিক সিগন্যালে, বিয়ের অনুষ্ঠানে এমনকি বাসা বাড়িতে গিয়েও জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করছে হিজড়ারা। এদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হয়েও সুরাহা পান না ভুক্তভোগীরা। খোদ রাজধানীতেই হিজড়াদের ৪০টি ডেরা’র খোঁজ মিলেছে। এসব ডেরায় গুরু মা’র অধীনে ১০ থেকে ১২ হাজার হিজড়া/ শিষ্য রয়েছেন। এরা দৈনিক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছেন। চাঁদাবাজির অর্থ দিয়ে শিষ্যের পেট চালাতে কষ্ট হলেও গুরু মা’রা গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি, চলছেন গাড়িতে। রয়েছে ইট ভাটা ও গার্মেন্টস ব্যবসাও। একটি অনুসন্ধান রিপোর্টে এমনটি উঠে এসেছে।

সাধারণ মানুষ যেমন হিজড়াদের অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন, হিজড়াদেরও তেমনি রয়েছে অনেক বঞ্চনার কাহিনী। কেউ জন্মগতভাবে হিজড়া হয়ে জন্মালে বঞ্চনায় তাকে ছাড়তে হচ্ছে পরিবার ও সমাজ। কোথাও স্থান না পেয়ে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারায় বাধ্য হয়ে তাদের যোগ দিতে হচ্ছে হিজড়া সমাজে। গুরু মা’র নির্দেশে নামতে হচ্ছে চাঁদা আদায়ে। অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে সার্জারীর মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করে হিজড়ায় রুপান্তরিত হচ্ছেন।

হিজড়াদের চাঁদা তোলা অনেক পুরনো। আগে মানুষ যা দিত, তা নিয়েই খুশি থাকত। ইদানীং হিজড়াদের আচরণ বদলে গেছে। রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি, দোকানপাট যেখানে-সেখানে টাকার জন্য মানুষকে নাজেহাল করছেন তারা। সম্প্রতি রিকশায় চড়ে যাচ্ছিলেন একজন ছেলে ও একজন মেয়ে। আরামবাগ ট্রাফিক সিগন্যালে রিকশা থামতেই লাল রঙের লিপস্টিক, কপালে কালো টিপ, কড়া মেকআপ করা এক হিজড়া রিকশার কাছে এসে ১০০ টাকা দাবি করলেন। ছেলেটা ৫০ টাকা দিতে চাইলেন। হিজড়ার দাবি অনুযায়ী ১০০ টাকাই দিতে হবে। পরে ছেলেটা ১০০ টাকা দিতে বাধ্য হলেন। ছেলেটা বললেন, সঙ্গে মেয়ে মানুষ। ১০০ টাকা না দিলে নাজেহাল হতে হতো। এর আগেই দিয়ে দিয়েছি। টাকা হাতে নিয়েই ওই হিজড়া ছুটে গেলেন একটি ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে। সিগন্যাল ছাড়ার আগ পর্যন্ত অন্য যানবাহনের যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক। কাছে এসে ধরলে টাকা না দিয়ে তো উপায় নেই। সিগন্যাল ছাড়লে একেকজন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন! একই সিগন্যালে একই সময়ে আরও দুজন হিজড়া এভাবেই টাকা তুলছিলেন।

একটি প্রাইভেটকার ফুল দিয়ে সাজানো। দেখে বোঝাই যাচ্ছে, গাড়ির ভেতরে বর বসে আছেন। পেছনে বরযাত্রীর আরও ৩টি গাড়ি। গাড়িগুলো শ্যামলী থেকে মিরপুরের দিক যাচ্ছিল। গাড়িটা যখন টেকনিক্যাল মোড় সিগন্যালের পৌঁছালো, ঠিক তখনি হাত উচু করে গাড়ি দাঁড়ানোর সিগন্যাল দেন একজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য। সিগন্যালটি পড়তে না পড়তেই সাতজন হিজড়া এসে বরের গাড়িটি ঘিরে ধরেন। তারা পাঁচ হাজার টাকা দাবি করেন। পেছনের গাড়িতে থাকা বরের ভাইসহ বেশ কয়েকজন দ্রুত বেরিয়ে আসেন। হিজড়াদের বুঝানোর চেষ্টা করেন। কোন লাভ হয়নি। সাতজন হিজড়া একত্রে বরের প্রাইভেট কারটি এত জোরে আঘাত করছিল যে, ধিম ধিম আওয়াজ হচ্ছিল। বরের সঙ্গে থাকা এক নারী ও বাচ্চা চিৎকার করতে শুরু করল। তবুও হিজড়াদের মন গলানো গেল না। শেষ পর্যন্ত ৪ হাজার টাকা দিয়ে মুক্তি।

হিজড়াদের হাতে নাজেহালের শিকার হয়ে সম্প্রতি ফেসবুকে স্ট্যাস্টাস দিয়েছেন হাজারীবাগের বাসিন্দা ইয়ামিন। পরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, গত ২৪ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টা। তিনি তখন অফিসে। বাসায় সদ্য জন্ম নেয়া শিশু সন্তান, তার স্ত্রী ও শাশুড়ি। বারান্দায় বাচ্চার জমা-কাপড় মেলা দেখে ৪ সদস্যদের একদল হিজড়া এসে বাসার কলিং বেল বাজায়। তার স্ত্রী দরজা খুলতেই হিজড়ারা শয়ন কক্ষে ঢুকে পড়ে। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ২ হাজার টাকা দাবি করে। একপর্যায়ে তার স্ত্রী ৫০০ টাকা দিতে চাইলেও নিবে না বলে জানায়। বাচ্চাকে ওপরে শূণ্যে ছুড়ে খেলা করতে থাকে। এমনটি দেখে স্ত্রী ও শাশুড়ি চিৎকার করে ওঠেন। তখন পাশের বাসার বাসিন্দারা ছুটে আসেন। প্রতিবেশীসহ সবাই হিজড়াদের ১ হাজার টাকা দিতে চাইলেও কাজ হয়নি। পুলিশকে ফোন করলে বলা হয়, ‘কম-বেশি দিয়ে বুঝিয়ে-শুনিয়ে পাঠিয়ে দেন।’ প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার নিয়ে ২ হাজার টাকা দিয়েই হিজড়াদের বিদায় করতে হয়।

আবাসিক এলাকা ছাড়াও এদের উপদ্রব বেশি চোখে পড়ে ঢাকার প্রবেশ মুখে, বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ও পার্কের আশপাশে। সন্ধ্যা হলেই কারওয়ান বাজার সংলগ্ন পান্থকুঞ্জ পার্কে এসে ভিড় করে একদল হিজড়া। ওই পথে পায়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীদের নানা অঙ্গভঙ্গিতে ডাকে। এদের ডাকে সারা দিয়ে কেউ পার্কের ভিতরে গেলেই সর্বস্ব হারিয়ে বের হতে হয়। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের এই অপকর্মের শেল্টার দিয়ে থাকে চাঁদার ভাগ পাওয়া স্থানীয় কয়েকজন যুবক।

সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হিজড়াদের জোর করে আদায় করা টাকার পুরোটাই চলে যায় গুরু মা’র হাতে। বেশ কয়েকজন হিজড়া জানান, প্রত্যেক হিজড়াই কোন না কোন ডেরা’র গুরু মা’র অধীনে। কালেকশনের ৩ ভাগের ২ ভাগই দিন শেষে জমা দিতে হয় গুরু মা’র কাছে। সকালে ডেরা থেকে বের হওয়ার আগে এলাকাভিত্তিক চাঁদার টার্গেট দিয়ে দেন গুরু মা। ৮০০ টাকা টার্গেট দিলে একজন হিজড়াকে ১২/১৩ শ’ টাকা তুলতে হয়। তাই তারাও মানুষকে বাধ্য করে অধিক টাকা তুলছেন। এছাড়া বর্তমানে সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। তারা বলেন, তাদের কাছে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। ভাড়া দিলেও অন্যের তুলনায় বেশি টাকা নিচ্ছে। সিএনজি চালক বেশি টাকা নিচ্ছে। এমন অনেক খাত রয়েছে, যেখানে একজন স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে তাদের বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে। এসব কারণে তারাও বেশি টাকা আদায় করছেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশনস) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, অনেক সময় হিজড়াদের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হয় না। এদের নিয়ে অনেক সংস্থাই কাজ করে। সম্প্রতি চাঁদাবাজির অভিযোগে বেশ কয়েকজন হিজড়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগে এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করিয়ে দিতে হবে। এদের উপদ্রবের বিষয়টি থানা পর্যায়ের পুলিশও বলছে। বিষয়টি আমরা গুরুত্বসহকারে দেখছি। এদের নাজেহালের বিষয়টি কোন ভুক্তভোগী সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে জানানোর পরও পুলিশি সহায়তা না পেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কিংবা থানার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। হিজড়াদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে ডিএমপির ৫০ থানা পুলিশকে এ মাসেই একটি বার্তা পাঠানোর কথাও বলেছেন তিনি।

রাজধানীতে ৪০ ডেরা ও গুরু মাঃ একজন হিজড়া যখন পরিবার কিংবা সমাজের কারণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন তাকে ঠাঁই নিতে হয় হিজড়াদের যেকোন একটি ডেরা’য়। ওই ডেরা’র গুরু মা তাকে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে হিজড়াগিরি পেশায় নামান। রাজপথে কালেকশন করতে গিয়ে কিংবা অন্য কোন ধরনের বিপদে পড়লে গুরু মা শেল্টার দিয়ে থাকেন। তাই গুরু মা’র কথার অবাধ্য হন না কোন হিজড়াই। অনুসন্ধানে রাজধানীতে এমন ৪০টি ডেরা ও এর গুরু মা’র সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো- উত্তরা আব্দুল্লাহপুরে অবস্থিত ডেরা’র গুরু মা ৩ বছর আগে মারা যান। বর্তমানে তারই ৪ জন শিষ্য আব্দুল্লাহপুর, পূর্বাঞ্চল, রুপগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের কিছু অংশ নিয়ে ৪টি ডেরা চালু করেন। কামারপাড়া, আশুলিয়ার কিছু অংশ ও বিমানবন্দরের পেছনের অংশ নিয়ে রয়েছে আরেকটি ডেরা। এই ডেরা একজন গুরু মা ও তার শিষ্য মিলে পরিচালনা করছেন। হাজী ক্যাম্প থেকে বাড্ডা সুবাস্তু টাওয়ার, প্রগতী স্মরণী এলাকা নিয়ে রয়েছে আরেকটি ডেরা। ৬০ ও ১০০ ফিট, বাড্ডা বেরাইদ এলাকা নিয়ে একটি ডেরা। ডিওএইচএস, বাড়িধারা ও গুলশানের এক অংশ নিয়ে রয়েছে একটি ডেরা। গুলশান লেক, উত্তর বাড্ডা বাজার থেকে আমেরিকান দূতাবাস পর্যন্ত এক গুরু মা’র। এদিকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত রয়েছেন আরেক গুরু মা’র অধীনে। মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট থেকে আফতাব নগর পর্যন্ত রয়েছে নতুন ডেরা। রামপুরা টিভি সেন্টার থেকে রামপুরা বাজার, উলন রোড একজন গুরু মা’র অধীনে। বনশ্রী, খিলগাঁও ও মালিবাগ রয়েছে একটি ডেরা। শুধু বাসাবোতে রয়েছে একটি ডেরা। শাহজাহানপুর, শান্তিবাগ এলাকা এক গুরু মা’র অধীনে। কমলাপুর, মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, শান্তিবাগ এলাকা মিলে রয়েছে একটি ডেরা। আরকে মিশন রোড, টিকাটুলি এলাকা মিলে একটি ডেরা। মুগদা, মান্ডা, গ্রীন মডেল টাউন এলাকা রয়েছে এক গুরু মা’র অধীনে। মানিকনগর, স্মৃতি পল্লী, গোলাপবাগ, যাত্রাবাড়ী মাছের আড়ৎ এলাকা পর্যন্ত রয়েছে ২টি ডেরা।

নারিন্দা, সূত্রাপুর, দয়াগঞ্জ, শ্যামবাজার এলাকার ডেরা’র গুরু মা’র দয়াগঞ্জ এলাকা রয়েছে বিলাশবহুল বাড়ি। যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, শনির আখড়া, জুরাইন, পোস্তখোলা এলাকার গুরু মা মারা যাওয়ার পর বর্তমানে তার ৫ জন শিষ্য ২টি ডেরায় বিভক্ত হয়ে হিজড়াদের পরিচালনা করছেন। তাতীবাজার, কোর্ট-কাচারী, বংশাল ও বাবুবাজারে ২টি ডেরা দু’জন গুরু মা’র অধীনে। পুরো কামরাঙ্গীরচরের হিজড়াদের আগের গুরু মা’র দুই শিষ্য পরিচালনা করছেন। লালবাগ, ধানমন্ডি ও নিউমার্কেট এলাকা মিলে রয়েছেন আরেকজন গুরু মা। ঝিগাতলা, রায়ের বাজার, বেড়িবাঁধ মিলে একটি ডেরা। লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, বাঁশবাড়ি ও বছিলা এলাকা মিলে আরেকটি ডেরা। আদাবর, শেখের টেক ও শ্যামলীর আগের গুরু মা মারা যাওয়ার পর বর্তমানে দুজন হিজড়া ডেরাটি পরিচালনা করছেন। কল্যাণপুর, পীরেরবাগের ডেরা পরিচালনা করেন দুজন গুরু মা। মিরপুর মাজার রোড ও গাবতলীতে রয়েছে একটি ডেরা। মিরপুর-২, ৩, পল্লবী ও পূরবীতে রয়েছেন একজন গুরু মা। মিরপুর-১০, ১১ ও ১৩ মিলে রয়েছে আরেকটি ডেরা। বনানী, কড়াইল বস্তি এলাকার হিজড়াদের নেতৃত্ব দেন তিনজন গুরু মা। মগবাজার, রমনায় রয়েছেন একজন গুরু মা। কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট ও সংসদ ভবন এলাকায় রয়েছে আরেকটি ডেরা।

এর মধ্যে শ্যামপুর ডেরায় রয়েছেন ২০০ জন হিজড়া। মুগদায় রয়েছেন ৪০ জন। কমলাপুর ডেরায় থাকেন ৮০ জন। এভাবে কোন ডেরায় দুই শতাধিকের অধিক, কোনটিতে এরও কম সংখ্যক হিজড়া গুরু মা’র অধীন রয়েছেন। অনেক ডেরার অধীনে ওয়ার্ড ও থানাভিত্তিক সাব-গুরু মা’ও রয়েছেন। এক ডেরার কিংবা এলাকার হিজড়া অন্য এলাকায় গিয়ে টাকা কালেকশন করতে পারেন না। এতে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদের মধ্যে অনেক গুরু মা হিজড়াদের সঙ্গে একত্রে ডেরায় থাকেন। অনেকে আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। যারা শিষ্যের চাঁদায় বাড়ি বানিয়েছেন, তারা ওই বাড়িতেই থাকেন। অধিকাংশ গুরু মা ২/৩ জন শিষ্যকে দাসী হিসেবে রাখেন, যারা সর্বদা গুরু মা’র সেবাযত্ম করেন।

একাধিক গুরু মা, হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ও আগে গুরু মা’র দায়িত্ব পালন করলেও বর্তমানে বিভিন্ন সংগঠন করছেন এমন অনেকে জানিয়েছেন, এই ৪০টি ডেরায় ১০ থেকে ১২ হাজার হিজড়া রয়েছেন। অন্তত ৩০ জন হিজড়া জানিয়েছেন, দৈনিক গড়ে ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা কালেকশন করেন প্রত্যেক হিজড়া। সেই হিসেবে একজন হিজড়া দৈনিক ১ হাজার টাকা করে চাঁদা তুললে ৪০টি ডেরার ১০ হাজার হিজড়া দিনে ১ কোটি টাকা চাঁদা তুলছে। অনেক গুরু মা’র নিয়ম হচ্ছে- কালেকশনের সব টাকাই তার কাছে জমা দিতে হয়। ওই টাকায় গুরু মা ঘর ভাড়া, থাকা-খাওয়া, হাত খরচসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করে যা থাকে, সেগুলো নিজেই রাখেন। আর কোন কোন ডেরা’র গুরু মা’র নিয়ম হচ্ছে- তিনি শিষ্যকে ৮০০ কিংবা ৯০০ টাকার টার্গেট দেন। শিষ্য দিন শেষে তাকে এই পরিমাণ টাকা জমা দেন। শিষ্যের কাছে বাকি যে টাকা থাকে, তা দিয়ে বাজার খরচ, হাত খরচসহ অন্যান খাতে ব্যয় করা হয়। তবে হিজড়ারা গুরু মা’কে দৈনিক যে পরিমাণ চাঁদার টাকা জমা দেন, বলা চলে এর পুরোটাই থেকে যায়। ডেরায় হিজড়া সংখ্যা হিসেবে কোন গুরু মা দৈনিক ৫০ হাজার, কোন গুরু মা ১ লাখ টাকা চাঁদার ভাগ থাকে।

হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একে তো হিজড়াদের পড়াশোনা নেই। আবার কর্মসংস্থানের সুযোগও নেই। তবে কর্মসংস্থানের সুযোগ যতটুকুই আছে, তাও হিজড়ারা ৮/১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতে চাচ্ছেন না। কেননা, একজন হিজড়া দিনেই এক/দেড় হাজার টাকা কালেকশন করেন। নগদ টাকার মজা তারা আগেই বুঝে গেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন গুরু মা বলছেন, বিয়ে বাড়িতে নাচ-গান করা, দোকানে গিয়ে ১০/২০ টাকা কালেকশন করা, বাচ্চা নাচানো আসল হিজড়াগিরি। এর বাইরে অনেক গ্রুপ মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায় করছে। মানুষকে হয়রানি করছে। যেসকল গুরু মা কিংবা গুরু মা’র লোকজন এমনটি করে, তাদের আইনের আওতায় আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থায় চিঠিও দেয়া হয়েছে। কেননা, কয়েকজন হিজড়ার অপকর্মের দায় পুরো হিজড়া সম্প্রদায়ের ওপর বর্তায়।

শিষ্যের চাঁদায় গুরু মা’র বাড়ি-গাড়িঃ মাঠ পর্যায়ে টাকা কালেকশন করা হিজড়ারা পেট পুরে খেতে না পারলেও এদের ঘাম ঝরানো চাঁদায় আলিশান বাড়ি-গাড়ি গড়েছেন শুরু মা’দের অনেকে। এরকম কয়েকজন গুরু মা’র সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা শুধু বাড়ি-গাড়ি-ই নয়; ইট ভাটারও মালিক। রয়েছে গার্মেন্টস ব্যবসাও। মিরপুর-১১, ১২ ও ১৩ নম্বরের গুরু মা’র ১৩ নম্বরে ৪ কাঠা জমিতে একটি বাড়ি রয়েছে। ৪ বছর আগে বাড়িটি বানিয়েছেন তিনি। অথচ কয়েক বছর আগেও সংসদ ভবন এলাকায় বাদাম বিক্রি করতেন ওই গুরু মা। শিষ্যের চাঁদার টাকায় কেনা গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। নারিন্দা, সূত্রাপুর, দয়াগঞ্জ, শ্যামবাজার এলাকার ডেরা’র গুরু মা’র দয়াগঞ্জ এলাকায় রয়েছে বিলাশবহুল বাড়ি। ঢাকার একটু দূরে আশুলিয়ার বাগমারীতে রয়েছে আরেক গুরু মা’র ৪ তলা ও ৫ তলার দুটি বাড়ি। সাভারের ধামরাইয়ে রয়েছে তার ইট ভাটাও।

মিরপুর হলি ফ্যামেলি পাবলিক কলেজের পাশেই রয়েছে আরেকজন গুরু মা’র বাড়ি। বাড়িটিতে তিনি পোশাক কারখানা গড়ে তুলেছেন। এছাড়া তার ৩টি ফ্ল্যাট ও একটি দোকান রয়েছে। ওই ভবনে রয়েছে অফিস কক্ষও। প্রায়ই হিজড়া নেতাদের মিটিং হয় সেখানে। নামী-দামী গাড়িতে চড়ে ওই ভবনে আসতে দেখা গেছে একাধিক গুরু মা’কে। জমি ক্রয় করে ওই সব ভবন নির্মাণ করেছেন তারা। যাদের কাছ থেকে গুরু মা’রা জমি ক্রয় করেছেন, তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এলাকার লোকজন ওই সব বাড়ি হিজড়াদের বাড়ি হিসেবে বলে থাকেন। অবৈধ আয়ে গড়ে তোলা এই অবৈধ সম্পত্তি জব্দ করে তা মাঠ পর্যায়ের হিজড়াদের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।