• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪২ পূর্বাহ্ন

ঢাকায় বেপরোয়া অজ্ঞান পার্টি : বিষাক্ত ওষুধে যাচ্ছে প্রাণ, ভুগছেন জটিল ব্যাধিতে


প্রকাশের সময় : অক্টোবর ২১, ২০২২, ৪:৫৫ অপরাহ্ন / ৯৫
ঢাকায় বেপরোয়া অজ্ঞান পার্টি : বিষাক্ত ওষুধে যাচ্ছে প্রাণ, ভুগছেন জটিল ব্যাধিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকায় অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা আবারও বেড়েছে। প্রতিনিয়ত এদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন মানুষ। পুলিশ, ব্যবসায়ী, প্রবাসী কেউই বাদ পড়ছেন না এ দুর্বৃত্তদের কবল থেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির মধ্যেও নগরীতে অন্তত দুই ডজন চক্রের শতাধিক সদস্য সক্রিয় রয়েছে বলে একটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।

অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা বিষাক্ত চেতনানাশক মেশানো কোমল পানীয় কিংবা খাবার খাইয়ে অজ্ঞান করে মানুষের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে। এসব চেতনানাশকের প্রভাবে কেউ মারা যাচ্ছেন, আবার কেউ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরলেও জটিল নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন।

জানা গেছে, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা রেলস্টেশন, বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন জনবহুল স্থানে ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ বুঝে বেশি পাওয়ারের চেতনানাশক মেশানো জুস-শরবত, কফি-চা, খেজুর, ডাবের পানিসহ অন্য সামগ্রী খাইয়ে মানুষকে অজ্ঞান করে সব লুটে নেয়। আবার কখনো বাস, ট্রেন, লঞ্চে যাত্রীদের পাশে বসে তাদের নাকের কাছে চেতনানাশক ওষুধে ভেজানো রুমাল দিয়ে স্পর্শ করে যাত্রীদের অজ্ঞান করে। পরে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়। ইদানীং প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা যেসব ওষুধ ব্যবহার করে, তা অতিমাত্রায় দেওয়ার কারণে কারও কারও মৃত্যু ঘটে। আবার যারা বেঁচে যান তাদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। মুখে খাওয়ানো হলে তা পাকস্থলী লিভার এবং কিডনিতে মারাত্মক ধরনের ক্ষতি করে। আর নাকে যেটা দেওয়া হয়, তাতে ফুসফুস এবং মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি করে। তিনি বলেন, এসব ক্ষতিকর ওষুধ মানুষের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। এতে শরীরে নানা জটিল রোগব্যাধি বাসা বাধে। গর্ভবতী নারীকে প্রয়োগ করা হলে তার গর্ভের সন্তানের ওপর প্রভাব পড়ে। অজ্ঞান পার্টির খপ্পর থেকে বাঁচতে বাসে-ট্রেনে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এখানে প্রতি মাসে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ২০ থেকে ২৫ জন রোগী চিকিৎসা নেন। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা জেনারেল হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিনই অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে লোকজন এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

সূত্র জানিয়েছে, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা চেতনানাশক ট্যাবলেট হিসাবে মাইলাম, ডরমিটল, লোনাজেপ, এটিভেন, ডর্মিকাম ব্যবহার করে। এসব ওষুধ তারা নগরীর বিভিন্ন এলাকার অসাধু ফার্মেসি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে।

১ অক্টোবর উত্তরায় ইমরান হোসেন (৩৫) নামের এক বায়িং হাউজের কর্মকর্তা অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা খুইয়েছেন। ১২ অক্টোবর ওমান থেকে ঢাকায় ফিরে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার বাসিন্দা প্রবাসী আবুল হোসেন। তাকে অচেতন করে কাকরাইল এলাকায় ফেলে রেখে তার লাগেজসহ সবকিছু নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। একই দিন বিমানবন্দর থানা এলাকায় অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা খুইয়েছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী আলাউদ্দিন। এছাড়া যাত্রাবাড়ী এলাকায় অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন কাপড় ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম (৩৫)। তাদের ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর আগে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ সেপ্টেম্বর মারা যান মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বেতকা গ্রামের আব্দুল্লাহ বাবু (৬০)। তিনি পরিবার নিয়ে মুগদা মাণ্ডার প্রথম গলিতে থাকতেন। গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারে ব্যবসা করতেন। ভৈরব থেকে ফেরার পথে ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন। পরে কমলাপুর এলাকায় একটি বাস কাউন্টার থেকে তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে তিনি মারা যান।

এছাড়া ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে বরিশাল ফেরার পথে বাসে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে মারা যান একটি বিমা কোম্পানির কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন (৪০)। ৪ অক্টোবর গাজীপুর থেকে ভিআইপি পরিবহণে আজিমপুরে ফেরার পথে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে পলিথিন ব্যবসায়ী আলমগীর ৮ লাখ টাকা খুইয়েছেন। ২৫ সেপ্টেম্বর চকবাজারের বেপারি স্টোর নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক সাহেব আলী (৪৫) উত্তরা থেকে ফেরার পথে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তাকে অজ্ঞান করে এক লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। ২৫ সেপ্টেম্বর মেঘনা থেকে গুলিস্তানে ফেরার পথে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী আবুল কাশেম। তাকে গুলিস্তান থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

২১ সেপ্টেম্বর সায়েদাবাদে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়ান এসবির পুলিশ সদস্য শামসুল আলম (৪০)। পরে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এছাড়া ৩ আগস্ট গুলিস্তানে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন গাজীপুরের পুলিশ পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম (৫২)।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা মহাখালী হতে টঙ্গী-গাজীপুর-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল রুটে, গাবতলী হতে সাভার-আশুলিয়া-চান্দুরা-মানিকগঞ্জ রুটে, যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদ হতে মাওয়া-চিটাগাং রোড-নারায়ণগঞ্জ রুটেও কখনও হকারবেশে, কখনও সাধারণ যাত্রীবেশে বাসে ওঠে। যাত্রীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে কৌশলে চেতনানাশক মিশ্রিত খাবার খাইয়ে সব লুটে নিয়ে বাস থেকে নেমে যায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশনস বিভাগের ডিসি মো. ফারুক হোসেন যুগান্তরকে বলেন-অজ্ঞান পার্টি, মলমপার্টি, ছিনতাইকারীসহ বিভিন্ন অপরাধীদের ধরতে ডিএমপির অভিযান অব্যাহত আছে। তবে অজ্ঞান পার্টির কবল থেকে মুক্ত থাকতে যাত্রীদের সচেতনতার বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।