• ঢাকা
  • শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ১০:১৫ অপরাহ্ন

ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল ভূমি অফিস যেন ঘুষের আস্তানা : এসিল্যান্ড থেকে পিয়ন সবাই একাট্টা


প্রকাশের সময় : মে ৪, ২০২৫, ৭:২৮ অপরাহ্ন / ৩৯
ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল ভূমি অফিস যেন ঘুষের আস্তানা : এসিল্যান্ড থেকে পিয়ন সবাই একাট্টা

“ঘুষের টাকা গণনা এখানে ওপেন সিক্রেট। স্থানীয় সাংবাদিকরাই দালাল। ঘুষ গ্রহণকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন ঘুষের টাকা এসিল্যান্ড, কানুনগো, সার্ভেয়ার সকল কর্মকর্তার টেবিলে ভাগ যায়।”

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ অনিয়ম আর ঘুষ বাণিজ্যের আখড়ায় পরিণত হয়েছে ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল ভূমি অফিস। কেরানীগঞ্জ মডেল ভূমি অফিস যেন এক ঘুষের আস্তানা: এসিল্যান্ড থেকে পিয়ন সবাই যেন একাট্টা। পিওন থেকে শুরু করে এসিল্যান্ড সকলেই সেই টাকা নেন ভাগাভাগি করে। এখানে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ঘুষ এখন ডিজিটাল প্রতারণায় পরিনত হয়েছে। এসব অভিযোগে সরেজমিনে এমন তথ্য মিলেছে। এই ভূমি অফিসে কর্মরত অফিস সহায়ক মোঃ আজাহারুল হক সহ সকলেই অফিসের সেবা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে পদে পদে ঘুষ নেন ডিজিটাল কায়দায়। মডেল ভূমি অফিসের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ঘুষের টাকা গণনার ভিডিও রয়েছে আমাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদক দলের হাতে। এ সব নিয়ে সংবাদমাধ্যম এসিল্যান্ডকে একাধিকবার অবগত করলেও তিনি রয়েছেন নিশ্চুপ।

তথ্যসূত্র মতে, দীর্ঘদিন যাবত কেরানীগঞ্জ মডেল এসিল্যান্ড অফিসে কর্মরত এই ভূমি অফিসের একাধিক কর্মকর্তা ও অফিস সহায়কের ঘুষ বাণিজ্য ও টাকা গণনা ওপেন সিক্রেট। স্থানীয় সাংবাদিকরা এখানে সংবাদ প্রকাশ না করে নিজেরাই দালালি সিন্ডিকেট চালায় বলে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে। সেবা প্রত্যাশিদের অসহায়ত্ব কাজে লাগিয়ে মাসে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য চলে। এরমধ্যে নামজারি, নাম সংশোধনসহ (ক) তালিকা (খ) তালিকা খাস সম্পত্তি, অর্পিত সম্পত্তি এগুলো গেজেট দেখে (খ) তালিকা সম্পত্তি অবমুক্ত হলেও পাট ভি,পি দেখিয়ে ভুক্তভোগী জনসাধারণের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয় বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা৷ অপরদিকে (ক) তালিকার খাস অর্পিত তালিকার দাগ নাম্বার থাকলেও সেটা আংশিক আপত্তি বলে গ্রাহকের নিকট থেকে ৫০ হাজার টাকা থেকে ১ লক্ষ টাকা নিয়ে থাকেন তিনি।

এই অফিসের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে আকড়ে রাখার পাশাপাশি অন্য কোথাও বদলি হলে আবার টাকা পয়সা খরচ করে বদলী হয়ে আসেন। সবাই বলে এই অফিসে মধু আছে।

মোঃ আজাহারুল হক কিছুদিন আগে অন্যত্র বদলি হলেও আবার মোটা অংকের ঘুষ বিনিময় কেরানীগঞ্জ মডেল অফিসে যোগ দিয়ে বর্তমানে গড়ে তুলেছেন ঘুষের শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। এখান থেকে অবৈধ সম্পদের মালিক বনে গেছেন তিনি। এরই মধ্যে অফিসের অনেকেই ঘুষ বাণিজ্যে জড়িয়ে বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। ভূমি-সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যা সমাধানে পকেট কাটা হচ্ছে ভুক্তভোগী সেবা প্রত্যাশীদের। এমন হাজারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কেরানীগঞ্জ মডেল ভুমি অফিসে সেবা নিতে আসা এমন একজন আব্দুল আলিম। তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, এখানেই ইট পর্যন্ত ঘুষের সাথে জড়িত। টাকা ছাড়া কোন ফাইলে স্বাক্ষর দেননা এখানে দায়িত্বরতরা। ঘুষ চাওয়া ও গ্রহণ করায় এই অফিসের কারও লজ্জা নেই বলেও তিনি বলেন।

ব্যাপক তথ্য অনুসন্ধানে আরও বেশ কয়েকজনের নাম উঠে আসে তার মধ্যে অফিসের অফিস সহায়ক মোঃ আজাহারুল হক অন্যতম। এছাড়া, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জান্নাতুল মাওয়া, কানুনগো মোঃ শহিদুল ইসলাম, সার্ভেয়ার ও নাজির। এদের নাম ভাঙিয়ে প্রতিনিয়ত সেবা প্রার্থীদের পকেট কাটছে নিম্ন কর্মচারী ওই চক্রটি। ওই চক্রটি ঘুষের টাকা হাতানোর জন্য দালাল সিন্ডিকেট গঠন করেছে। ওই দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তাঁরা ঘুষের টাকা গ্রহণ করেন। এ অফিসে দালালদের শরণাপন্ন না হলে মাসের পর মাস ফাইল পড়ে থাকে। আর দালালদের দায়িত্ব দিলে আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগের মতো কাজ হয় নিমেষেই।

দীর্ঘ অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, সম্প্রতি কয়েকজন গ্রাহকের কাছ থেকে লিগ্যাল জমি, খাস জমি দেখিয়ে ৬৫ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছে মোঃ আজাহারুল হকসহ তার সহকর্মী সিন্ডিকেট।

অনুসন্ধান চলাকালীন সময়ে গোপন ক্যামেরায় অনেক তথ্য উঠে আসে। যেখানে দেখা যায় ঘুষের লেনদেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অফিস সহকারী বলেন, ঘুষের টাকা কমিশনার, কানুনগো, সার্ভেয়ার ও নাজির প্রত্যেক টেবিলেই ভাগ চলে যায়।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, অফিস সহায়ক আজহারুল হক প্রতিদিন ক তালিকা, খ তালিকা, খাস সম্পত্তি, অর্পিত সম্পত্তি এগুলো গেজেট দেখেন প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ টির মত। তাতে দেখা যায় প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। কোনো জমির নামজারি করতে হলে প্রথমে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। এরপর শুরু হয় ঘুষ-বাণিজ্য। আবেদনের পর ইউনিয়ন সহকারী ভূমি অফিস থেকে প্রতিবেদন নিতে হলে ঘুষ দিতে হয় এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা। এরপর সার্ভেয়ারের প্রতিবেদনও লাগে ঘুষ।

সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে কেরানীগঞ্জের স্থানীয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেবা প্রত্যাশীর কাছ জানা যায় , নামজারি করতে কেরানীগঞ্জ ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক আজহারুল হককে ৮ হাজার টাকা দিয়েছেন। এত টাকা ঘুষ দেওয়ার পরেও এখনো তিনি কাগজ হাতে পাননি। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, এ অফিসে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই যেন হয় না। আগের এসি ল্যান্ডের সময় ৩-৪ হাজার টাকায় নাম জারি করা যেত। এখন সেখানে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা না দিলে কাজ হয় না। অফিসে নতুন কর্মকর্তা এলেই ঘুষের পরিমাণ বেড়ে যায় দুই-তিন গুন। তিনি আরো বলেন, এখন দেখছি জমিজমা না থাকাই ভালো ছিল।

সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানী টিমের সাথে কয়েকজন দালালের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এছাড়াও ওই অফিসে ওৎ পেতে থাকা এসব দালাল সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্যে’র সঙ্গে কথা হয় অনুসন্ধানী টিমের। এ সময় ওই দালাল সিন্ডিকেটের সদস্যরা বলেন, ইউনিয়ন ভূমি অফিসে আগে দিতে হতো এক হাজার টাকা এখন লাগে দুই হাজার টাকা। এসিল্যান্ড অফিসে প্রস্তাব পত্রের জন্য প্রত্যেকটা ফাইল প্রতি দিতে হয় ৩ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে নতুন কর্মকর্তা যোগদানের কারনে বর্তমানে ঘুষের পরিমাণ এখন বেড়েছে। এ সময় তারা আরো বলেন, আপনারা সাংবাদিক। আপনাদের কোন কাজ থাকলে আমাদের দিলে কম খরচে করে দেব। তবে ৫ হাজারের নিচে দিলে হবে না।

সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে সহকারী কমিশনার অফিসের অফিস সহকারী আজারুল হক বলেন, যে কোনো জমির নামজারি করতে গেলে সমস্যা না থাকলেও ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লাগবে। সমস্যা থাকলে টাকা আরও দশগুণ বেশি লাগবে। তিনি আরও বলেন, প্রকৃত কত টাকা লাগবে কাগজ না দেখে বলা যাবে না। আপনাদের কাজের কোনো সমস্যা হবে না। আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারেন। আমরা অফিসের লোক অন্যদের কাছে কাজ দিলে হয়তো দেরি হবে। আমাদের কাছে কাজ দিলে কোনো সময় লাগবে না। আর আমাদের কাছে টাকা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা নেই।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অফিস সহকারী আজহারুল হক বলেন, আপনার সাথে পরে কথা বলব নিউজ করার দরকার নাই।

এ ব্যাপারে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জান্নাতুল মাওয়ার সাথে যোগাযোগ করা তিনি বলেন, জমির নামজারি করতে সরকারি খরচ ১ হাজার ১৭০ টাকা। এর বেশি কোনো টাকা নেওয়া হয় না। কেউ আমাদের নাম বলে টাকা নেয় কি না আমার জানা নেই। কিন্তু প্রতিবেদকের নিকট টাকা গণনার স্থিরচিত্র ও একাধিক ভিডিও এসিল্যান্ডকে মোবাইল ফোনে প্রদান করলেও রহস্যজনক কারণে তিনি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে চুপ থাকেন।

কেরানীগঞ্জ মডেল ভূমি অফিসের সকল দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঘুষ বন্ধের ব্যাপারে ভুক্তভোগীরা ভুমি উপদেষ্টা, ভুমি সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।