বিশেষ প্রতিনিধি,ঢাকা: ‘নির্দলীয়’ জেলা পরিষদ ভোটে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বড় বার্তা পেল আওয়ামী লীগ। গত সোমবার জেলা পরিষদ নির্বাচনে ৩৪ জেলায় চেয়ারম্যান পদে দল সমর্থিত প্রার্থীকে পরাজিত করে নয়টিতে জয় পেয়েছেন নিজ দলের বিদ্রোহীরা। আর একটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। দলীয় প্রার্থীদের পরাজয়ের পেছনে দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের ‘মাইম্যান’ কে বিজয়ী করা, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের চিত্র ফুটে উঠেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, টানা প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করেছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতা-কর্মীই এখন সুফল হিসেবে কী পেলেন সে হিসাব মেলাচ্ছেন। এতে অন্তঃকোন্দল বেড়েই চলেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর দুই মাস বাকি থাকতে গত সোমবার ৩৪ জেলায় চেয়ারম্যান পদে ভোট হয়। এই ভোটে বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই অংশ নেয়নি। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয়কে ভাবাচ্ছে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামকে। তবে কেন্দ্রের অনেক নেতাই বলছেন, এটা নির্দলীয় ভোট হওয়ায় কারও বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। আবার কেউ কেউ নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ দিতে ভোটের মাঠে লড়েছেন। সাময়িক মান অভিমানের কারণে তারা প্রার্থী হয়েছিলেন। যে কারণে দল সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, কোন্দল কিংবা প্রার্থীর জনপ্রিয়তার কারণে পরাজিত হয়নি, দল সমর্থিত প্রার্থীরা টাকা ব্যয় করতে পারেননি বলেই পরাজিত হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, কোন্দলের কারণে দলীয় সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন এমনটা বলা যাবে না। তবে যারাই দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন এবং তাদের যারা সমর্থন করেছেন দলের কাছে তারা চিহ্নিত। এদের বিরুদ্ধে দলীয় ফোরামেই সিদ্ধান্ত হবে। এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি।
দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের জেলা ভিত্তিক কোন্দলের শীর্ষে এখন নরসিংদী এবং ফরিদপুর। এ জেলায় কেন্দ্রীয় নেতা ও এমপিরা বহুধারায় বিভক্ত। একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করা যায়নি। যার প্রভাব পড়েছে জেলা পরিষদ নির্বাচনে। যে কারণে ‘মাইম্যান’ জিতিয়ে আনার প্রতিযোগিতায় দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফরিদপুরের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বনাম যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন এমপির মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এখানে ভোট হয়েছে আওয়ামী লীগ বনাম নিক্সন লীগের মধ্যে। নিক্সন চৌধুরীর সমর্থিত প্রার্থী শাহাদাত হোসেন চশমা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৬২৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের ফারুক হোসেন আনারস প্রতীকে পেয়েছেন ৫৪০ ভোট। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ফারুক হোসেনের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায় নগরকান্দা ও সালথা উপজেলার ফল প্রকাশের পর। এ দুটি উপজেলার সব চেয়ারম সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবর লাবু চৌধুরী ঘনিষ্ঠ হলেও সালথা উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোট পান ৩০টি, অন?্দিকে বিদ্রোহী প্রার্থী শাহাদত ভোট পান ৭৪টি। নগরকান্দায় ফারুক হোসেন পান ৪৮ ভোট, বিদ্রোহী প্রার্থী শাহাদত হোসেন পান ৮৪ ভোট। জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি গোলাম মোহাম্মাদ নাসির প্রকাশ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীর ভোট চান। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে হটিয়ে নিজের সমর্থিত প্রার্থীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে ফরিদপুরের রাজনীতিতে আরও স্পষ্ট হলো মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরীর প্রভাব। এর আগে নিজ এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও নিজের সমর্থিত প্রার্থীরা বেশি বিজয়ী হয়েছিলেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলায় পঞ্চম ধাপে অনুষ্ঠিত নয়টি ইউপির চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা তিনটি ইউপিতে জয় পায়। আর ছয়টি ইউপির চেয়ারম্যান পদে নিক্সনের সমর্থক স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হন। এর মধ্যে তিনটিতে আওয়ামী লীগের তিন প্রার্থী জামানত হারান।
নরসিংদীতে দলীয় প্রার্থী আবদুল মতিন ভূঁইয়ার পরাজয়ের জন্য অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিবাদকে বড় করে দেখা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই জেলায় সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতা নির্বাচন করা হলেও গৃহদাহ কমেনি। জেলার এমপিরা বহুধা ধারায় বিভক্ত হয়ে আছেন। এরই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। ফলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবদুল মতিন ভূঁইয়া নির্বাচনে হেরে গেছেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জয় পেয়েছেন নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য মনির হোসেন ভূঁইয়া। মনোহরদীতে বিদ্রোহী প্রার্থী মনির হোসেন ভূঁইয়া ১১০ ভোট পেলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল মতিন ভূঁইয়া পেয়েছেন মাত্র ৫৪ ভোট। বেলাবতে বিদ্রোহী প্রার্থী পেয়েছেন ৬৩ ভোট। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ৪১টি। কেউ কেউ বলছেন, দলীয় প্রার্থী আবদুল মতিন ভূঁইয়ার পরাজয়ের অন্যতম কারণ বিগত সময়ে তিনি জনপ্রতিনিধিদের কাছাকাছি ছিলেন না। সে কারণে জনপ্রতিনিধিরাও তাকে এবার বর্জন করেছে।
জানা গেছে, ফরিদপুর, নরসিংদী ছাড়াও ঝিনাইদহ, শেরপুর, দিনাজপুর, রংপুর, পঞ্চগড়, সুনামগঞ্জ ও কক্সবাজারে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। দিনাজপুরে অবশ্য জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কাছে হেরেছে আওয়ামী লীগ। এসব জেলায় কেন্দ্রীয় নেতা, প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে দূরত্ব রয়েছে তৃণমূলের। অনেকেই ‘মাইম্যান’ সৃষ্টিতে ব্যস্ত হওয়ায় দলীয় সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে চরম মাশুল দিতে হবে বলে মনে করেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। দলীয় সূত্রগুলো জানায়, সংগঠনের চেয়ে প্রশাসনের ওপর বেশি নির্ভর করছে সরকার। প্রশাসন দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সংগঠন গোছানোয় মনোযোগ নেই। ফলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল দিন দিন বেড়েই চলেছে।
সরকারের তিন মেয়াদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের সঙ্গে স্থানীয় নেতাদের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠছে। অনেক জায়গায় সাবেক সংসদ সদস্যদের সঙ্গে বর্তমান সংসদ সদস্যদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ে কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব বেড়েছে।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দল সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন এ কথা মানতে নারাজ দলের ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। তিনি বলেন, নির্দলীয় জেলা পরিষদ ভোটে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেয়নি। ফলে বলা যায় একতরফা ভোট হয়েছে। জেলা পরিষদে অনেকেই দলের সমর্থন প্রত্যাশী ছিলেন। তারা অনেকেই দলের সমর্থন না পেয়ে একজোট করে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে নেমেছেন। আবারও দলীয় প্রার্থী এ নির্বাচনে টাকা খরচ করতে না পেরে হেরে গেছেন। যারা বিদ্রোহী হয়েছেন তারা অর্থনৈতিক ভাবে মোটাতাজা। সে কারণে বিজয়ী হয়েছেন।
দলের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, রাজশাহী বিভাগে প্রতিটি জেলায় দলীয় নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থেকে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করেছেন। এতেই প্রমাণিত হয়েছে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে কেউ পরাজিত করতে পারে না।
আপনার মতামত লিখুন :