বিশেষ প্রতিনিধি : কক্সবাজারে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা। বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের অপব্যবহারসহ সামাজিক অবক্ষয়কে এ ঘটনার জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত এক মাসে ১৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত বুধবার স্বামী-সন্তান জিম্মি করে কক্সবাজার এক পর্যটক গৃহবধূ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর আগে ১৮ ডিসেম্বর শহরের নুনিয়ার ছাড় এলাকা থেকে তুলে নিয়ে এক স্কুলছাত্রীকে হোটেলে টানা দুদিন আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগে ওঠে। কক্সবাজার মডেল থানায় মামলা করেন ওই স্কুলছাত্রীর বাবা।
এ ছাড়া ৭ ডিসেম্বর ঝিলংজার মুহুরিপাড়া এলাকায় ধর্ষণের শিকার হন তৃতীয় শ্রেণির মাদ্রাসাছাত্রী। প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল। অভিযোগের পক্ষপাতমূলক তদন্ত, মামলা দায়েরে অনীহা, বিচারহীনতা, আর বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ধর্ষণ প্রবণতার মূলকারণ বলে দাবি করেছেন তারা। আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং দ্রুত সময়ে বিচার কার্যকর করা গেলে ধর্ষণের ঘটনা কমে আসবে বলেও মনে করেন তারা।
কক্সবাজার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, ১৬ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর এক মাসে জেলায় ১৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যেখানে নভেম্বরে আটটি এবং ডিসেম্বরে গিয়ে তা হয়েছে ১০টি। একই সময়ে নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৬টি। কাগজকলমে ১৮টি ধর্ষণের ঘটনা দেখা গেলেও বাস্তবে এ সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, অনেক ভুক্তভোগী বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত থাকেন। আবার অনেকে মামলার বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে আইনের আশ্রয় নিতে চান না। ফলে তালিকার বাইরে রয়ে যায় ধর্ষণের অনেক ঘটনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিজিটাল সময়ে ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের উদাসীনতা, মামলা করতে গিয়ে ভোগান্তি, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, ভুক্তভোগীদের মামলা করতে অনীহা এবং নারীর প্রতি দৃষ্টি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হওয়ার কারণে ধর্ষণ ব্যাধি লেগে আছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের দায়িত্বশীল আচরণ এবং দ্রুত বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
নারীনেত্রী ও সমাজকর্মী নাজনীন সরওয়ার কাবেরী বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা এবং মামলা তদন্তে পক্ষপাতের কারণে অভিযুক্তরা শাস্তির আওতায় আসে না। ফলে সুযোগ পেলেই অপরাধে জড়াচ্ছে বিকৃত মানসিকতার মানুষগুলো। দেশের প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
জাগো নারী নামে একটি বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক শিউলি শর্মা বলেন, বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের অপব্যবহার হচ্ছে। ফলে কিশোর বয়সের ছেলেরা পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি ধাবিত হয়ে ভালো কিছু গ্রহণ না করে মন্দকে গ্রহণ করছে। যার কারণে তাদের চিন্তা ও চেতনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ জন্য বাবা-মায়ের উদাসীনতাকেও দায়ী করেছেন তিনি। তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বুঝলাম নারীর প্রতি এখনও পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়নি। ফলে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়ও। এ অবস্থায় সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি।
লিগ্যালএইড কক্সবাজারের প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট বাপ্পী শর্মা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ও ৯(২) ধারায় ধর্ষণের দায়ে শাস্তির বিধান যাবজ্জীবন। আর মৃত্যু ঘটলে মৃত্যুদণ্ডের ২০(৩) ধারায় বিচারের জন্য মামলাপ্রাপ্তির ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য সমাপ্ত করার কথা। কিন্তু বাস্তবে সঠিক সময়ে তদন্ত কার্য শেষ হয় না। এ ছাড়া আদালতে উপযুক্ত সাক্ষী ও প্রমাণের অভাবে অনেক অপরাধী মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে যান। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে একমাত্র উপায় হচ্ছে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন।
এদিকে হোটেলে নারী ধর্ষণের ঘটনা ফলাও করে প্রকাশ পাওয়ার পর পর্যটনশিল্পে বিরুপ প্রভা ফেলবে বলে মনে করে কক্সবাজার চেম্বার অব কমাসের সভাপতি আবু মোর্শেদে চৌধুরী খোকা। তিনি বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনায় চরমভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে পর্যটনশিল্পকে ঘিরে। অনেক পর্যটক তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। আমাদের সুনাম রক্ষা করতে জেলা প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে পর্যটন জোনে নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। একই সঙ্গে পর্যটনশিল্পে যেন নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেদিকটি মাথায় রেখে কাজ করার জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি।
কক্সবাজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, এসব ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :