নিজস্ব প্রতিবেদক: সম্প্রতি ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ে বাড়িছাড়া কিছু তরুণ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। নতুন জঙ্গি সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। গোয়েন্দা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, দেশের পার্বত্য অঞ্চলে হঠাৎ মাথাচাড়া দেওয়া সংগঠনটি এখন ভয়ঙ্কররূপে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন করার নীলনকশাও বাস্তবায়নের অপচেষ্টা করে যাচ্ছে তারা।
পাহাড়ি সংগঠন ‘কেএনএফ’ এরই মধ্যে নিজস্ব পতাকা বানিয়েছে। তৈরি করেছে মনগড়া মানচিত্র। এসব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তথা আলাদা রাজ্য বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গড়েছে প্রশিক্ষিত নিজস্ব বাহিনী, যাদের দেওয়া হয়েছে সামরিক বাহিনীর আদলে কমান্ডো প্রশিক্ষণ। তাদের রয়েছে আলাদা ইউনিফর্ম, র্যাংকভিত্তিক আলাদা আলাদা ব্যাচ। ইউনিফর্মের হাতে রয়েছে তাদের নিজস্ব পতাকা। সম্প্রতি উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় হিজরতের নামে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ১৯ জেলার ৫৫ তরুণের তালিকা প্রকাশ করেছে র্যাব। তাদের মধ্যে ৩৮ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হয়েছে।
র্যাব জানায়, ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’। যার বাংলা অর্থ- পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার। এই সংগঠনের আহ্বানে বাড়ি ছাড়ে তরুণরা।
কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া অন্তত ৩৮ তরুণ বর্তমানে এই কেএনএফের অধীনে দুর্গম পাহাড়ে রয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থান তাদের হামলার টার্গেট হতে পারে- এমন গোয়েন্দা তথ্যের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও র্যাব যৌথ অভিযান পরিচালনা করছে।
নিখোঁজরা হলেন, মো. দিদার, তাহিয়াত চৌধুরী, আহাদ, মশিউর রহমান, সাখাওয়াত হোসাইন, আরিফুর রহমান, মো. নঈম হোসেন, শামীম মিয়া, আল আমিন ফকির, আমিনুল ইসলাম, মো. নাজমুল আলম নাহিদ, আল আমিন, শেখ আহমদ মামুন, মো. আস সামি রহমান, সাদিক, হাসান সাঈদ, বায়েজিদ, জুয়েল মুসল্লী, ইমরান রহমান শিথিল, সাইফুল ইসলাম তুহিন, আল আমিন, ইমরান, শিব্বির আহমদ, হাবিবুর রহমান, মুহাম্মদ আবু জাফর, যুবায়ের, নিহাদ আব্দুল্লাহ, মাহমুদ ডাকুয়া, আমির হোসেন, নাহিদ, সালেহ আহমাদ, রাব্বী আবদুস সালাম, ইয়াছিন ব্যাপারী, মো. মিরাজ সিকদার, ওবায়দুল্লাহ সাকিব, জহিরুল ইসলাম, আবু হুরায়রা ও আবুল বাশার মৃধা।
জানা যায়, পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে কেএনএফ’র আত্মপ্রকাশ বেশিদিন হয়নি। তবে এর মধ্যেই তারা তাদের ‘সামর্থ্য’ দেখিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংঘতি সমিতির (জেএসএস) ওপর হামলা চালিয়েছে। বলা হচ্ছে, এরা জেএসএসের প্রতিপক্ষ একটি দল। সম্প্রতি হামলা চালিয়ে জেএসএসের নেতাকে হত্যার পর পাহাড়ে কেএনএফ’কে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
কেএনএফ’র ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কার্যক্রমের নিয়মিত আপডেট তারা ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল দেয়। ফেসবুকে তাদের সদস্যদের ইউনিফর্ম পরা ছবি দিলেও মুখ ঘোলা করে দেওয়া হয়।
এক সময় জঙ্গি সংগঠন হুজির পাহাড়ে আস্তানা গাড়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছিল। আফগান ফেরতদের এই দল গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গাদের পক্ষ নিয়ে লড়াইয়ে অংশ নেওয়া।
নব্বইয়ের দশকে রোহিঙ্গাদের দুই সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (এআরএনও) সঙ্গে হুজির সম্পর্কের খবরও আলোচনায় আসে।
উগ্রবাদ বিষয়ে তথ্য সংরক্ষণকারী সাউথ এশিয়া টেরোরিজম পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালের ২৬ ও ২৭ আগস্ট বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির জঙ্গল থেকে পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয়।
তাদের ২০০৫ সালের মূল্যায়ন অনুযায়ী, বান্দরবানে জেএমবি বেশ তৎপরতা ছিল। তারা রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। এভাবে পাহাড়ে আশ্রয় নিলেও পাহাড়ি কোনো সংগঠনের সঙ্গে মুসলিম জঙ্গিদের যোগসাজশের খবর আগে পাওয়া যায়নি।
গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেছে, কুকি-চিন জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী। শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে অনগ্রসর হলেও নিকট অতীতে তারা শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের দাবি, পাহাড়ের সন্ত্রাসী দলগুলো তাদের এলাকা ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুমসহ নানা অপরাধ করছে। কুকি-চিন জনগোষ্ঠী তাদের অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে হাতে অঙ্কিত মানচিত্র প্রদর্শন করছে। তাদের দাবি, পূর্ণ স্বশাসনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ অঞ্চল সৃষ্টি করা সম্ভব। কিন্তু তাদের পতাকা তৈরির কারণে উদ্দেশ্য এবং বক্তব্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ করা যাচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, সশস্ত্র শাখার ক্যাডাররা ২০১৯ সালে ইনফ্যান্ট্রি কমান্ডো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে বলে গোয়েন্দা রিপোর্ট রয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলে খ্রিস্টান বাফার রাষ্ট্র তৈরির জন্য নতুনভাবে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পার্বত্যাঞ্চলের ৯টি উপজেলা নিয়ে কেএনএফর অঙ্কিত মানচিত্রের সীমানায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত একটি পৃথক রাজ্যের দাবিতে সংগঠনটি ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা করে। ২০১৭ সালে সশস্ত্র শাখায় রূপ নেয়। কিন্তু প্রকাশ্যে আসে সম্প্রতি। অথচ সংগঠনটি প্রাথমিক পর্যায়ে কেএনডিও নামে একটি সেবামূলক এনজিওর খোলসে যাত্রা শুরু করে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া তাদের বাছাই করা তরুণদের ছোট ছোট গ্রুপে সিনিয়র সদস্যের হেফাজতে রাখে। যেসব বাড়িতে রাখা হয়, সেটাকে তারা আনসার হাউজ (সাহায্যকারীর বাড়ি) বলে। এরপর চরাঞ্চলে শারীরিক কসরতসহ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে উত্তীর্ণদের প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানে কেএনএফ’র ক্যাম্পে পাঠানো হয়। কেএনএফ’র ক্যাম্পে এই জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শুরু হয় চলতি বছরের শুরুতে। সেখানে একে-৪৭ রাইফেল, পিস্তল ও কাটা বন্দুক চালানো, বোমা (আইইডি) তৈরি এবং চোরাগোপ্তা হামলার (অ্যাম্বুশ) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
র্যাব বলছে, গ্রেফতার কুমিল্লার মসজিদুল কোবার ইমাম হাবিবুল্লাহ দুই বছর ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে মাদরাসা চালাচ্ছিলেন। এছাড়া তারা দুর্গম এলাকায় আরও কিছু আস্তানার কথা জানতে পেরেছে, যেখানে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ চলছে।
রোববার (১৬ অক্টোবর) ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর কার্যালয়ে অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে প্রশিক্ষণরত নতুন যে জঙ্গি সংগঠনের খোঁজ মিলেছে সেটি আর পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ ক্যাম্পের অবস্থান পাশাপাশি ছিল বলে ধারণা করছি।
পার্বত্যাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কেএনএফ, তারপর সন্তু লারমার একটা বাহিনী রয়েছে, পার্বত্য এলাকায় আরও বাহিনী রয়েছে। এরা সবসময়ই আমাদের সীমান্ত এলাকায় একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে। আমাদের সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে পুলিশ, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায়ই রয়েছে। আমাদের পুলিশ, বিজিবি, র্যাব প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও সেখানে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আমরা আমাদের এলাকায় থাকতে দিচ্ছি না, তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যখনই টের পাচ্ছি যে, কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা কোনো জঙ্গি সংগঠন দেশের কোনো জায়গায় অবস্থান করছে, আমরা তাদের সরিয়ে দিচ্ছি।
এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কেএনএফের সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়গুলো আমরা দেখছি। যদি কানেকশন পাই সেটা ব্যবস্থা নিচ্ছি। জঙ্গিদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছি এবং কয়েকজনকে শনাক্ত করেছি। তাদের কাছ থেকে বিষয়গুলো জেনে আপনাদের জানাতে পারবো।
এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, দেশের কয়েকটি জেলা থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের খোঁজ করতে গিয়ে সম্প্রতি আমরা জানতে পারি, তারা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়িছাড়া হয়েছে। যারা অধিকাংশই নতুন একটি জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায় যুক্ত হয়েছে। এই সংগঠনের ১২ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই আমরা। কোন জেলা থেকে কতজন নিরুদ্দেশ হয়েছে সেই তালিকা আমাদের কাছে আছে। তাদের কারও কারও পরিবার জানে সন্তান বিদেশে গেছে, তারা মাঝে মধ্যে অর্থ পাঠায়। কিন্তু আসলে তারা জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হয়ে ঘর ছেড়েছে।
তিনি বলেন, পরে আমরা জানতে পারি নিরুদ্দেশ হওয়া ৩৮ জনের অধিকাংশই পার্বত্য অঞ্চলের ভেতর অবস্থান করছে। তারা সেখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ছত্রচ্ছায়ায় আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে এই তথ্য পেয়ে সেনাবাহিনীকে বিষয়টি অবগত করেছি। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য পাওয়ার পর সেনাবাহিনী ও র্যাব যৌথ অভিযান পরিচালনা করছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নাশকতা নিয়ে তাদের কী পরিকল্পনা, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান চলছে। আরও গ্রেফতার হলে তারপর তাদের পরিকল্পনার বিষয়ে বলা যাবে।
আপনার মতামত লিখুন :