• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ০৪:২৫ পূর্বাহ্ন

কারা বাসে আগুন দিয়েছে এ নিয়ে চলছে দুদলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ! 


প্রকাশের সময় : জুলাই ৩১, ২০২৩, ৯:০৮ পূর্বাহ্ন / ৭৮
কারা বাসে আগুন দিয়েছে এ নিয়ে চলছে দুদলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ! 

এম রাসেল সরকার, ঢাকাঃ দুই প্রধান দলের কর্মসূচি চলাকালে বাসে কারা আগুন দিয়েছে, এ নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। গত শনিবার রাজধানীতে বাসে আগুন লাগানোর দায় নিচ্ছে না কেউ। বিএনপি বলছে, তাদের কেউ আগুন দেয়নি। আওয়ামীলীগ অগ্নিসংযোগ করে বিএনপির ওপর দায় চাপাচ্ছে। এটা তাদের পুরোনো সংস্কৃতি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি পুরোনো অগ্নি সন্ত্রাসের দিকে ফিরে যাচ্ছে। তারা অস্থিতিশীলতা তৈরির জন্য আগুন সন্ত্রাস করছে।

দু’দলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যে অগ্নিসংযোগকারীদের এখনো শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজপথে এভাবে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় কোনো দলের নয়, বরং প্রশিক্ষিত ভাড়াটে অপরাধী হতে পারে। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, অগ্নিসংযোগকারীরা সরাসরি কোনো দলের কর্মী, না ভাড়াটে সে বিষয়ে এখনই নিশ্চিত ভাবে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। তবে এ ঘটনার পেছনের উদ্দেশ্য যে রাজনৈতিক তা একেবারে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। বিবদমান কোনো না কোনো দল এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া এ ঘটনায় বাস চালক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা গণমাধ্যমের কাছে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা খুবই গুরুত্ব বহন করে।

কিভাবে পুলিশের উপস্থিতিতে দুই যুবক পেট্রোল ঢেলে বাসে আগুন দিয়ে নিরাপদে চলে যেতে পারল এটাই অনেক বড় প্রশ্ন। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষতার সঙ্গে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে আগুন সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করতেই হবে।

শনিবার ঢাকার প্রবেশমুখে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি পালনকে ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজধানী। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এ সময় রাজধানীর মাতুয়াইল, উত্তরা ও শ্যামলীতে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ আগুনের ঘটনাগুলো নানা রহস্যের জন্ম দিয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বাসে অগ্নিসংযোগের ধরন এবং জড়িতদের কথোপকথন ঘিরেই এই রহস্যের সূত্রপাত। আগুনের ঘটনা কাছ থেকে যারা দেখেছেন তাদের কাছে বিষয়টি খুবই রহস্যঘেরা মনে হয়েছে। তারা দেখেছেন কিভাবে ঠান্ডা মাথায় দুই যুবক পেট্রোল ঢেলে বাসে আগুন দিয়ে ভিডিও করে মোটরসাইকেলে চলে যায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন লাগিয়ে তারা সটকে পড়ে।

ঘটনার তিন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, রাজধানী শহরের দিক থেকে একটি মোটরসাইকেল আসে। তারা বাসটিতে আগুন দিয়ে ভিডিও করে এবং সেলফি তোলে। তারপর দ্রুত স্থানটি ত্যাগ করে।

সাব্বির আহমেদ নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সান্টু ফিলিং স্টেশন থেকে বাসটি বের হচ্ছিল। তখন বাসের ভেতরে শুধু চালক ছিলেন। দুজন গিয়ে তাকে জোর করে নামিয়ে আগুন দেয়। পরে মোটরসাইকেলে চড়ে তিনজন পালিয়ে যায়।

পুড়ে যাওয়া বাসটি এশিয়া কোচের বলে জানান চালক মো. সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, দুই-আড়াই লিটারের একটি বোতল নিয়ে দুই যুবক গাড়িতে ওঠে। এরপর বলে, তুই গাড়ি থেকে নামবি-নাকি তোর শরীরে পেট্রোল ঢালব। আমি গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করার সময় পর্যন্ত পাইনি। পরে লাফ দিয়ে নেমে যাই। ঘটনার সময় দুই পাশেই পুলিশ ছিল। কোনো মিছিল ছিল না। তারা (অগ্নিসংযোগকারীরা) মোটরসাইকেল নিয়ে আসে। তারপর তারা তাদের কাজ করে নির্বিঘ্নে চলে যায়। তারা মূলত পেট্রোল ঢালে। এরপর গ্যাসলাইট দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।

অগ্নিসংযোগকারীদের বর্ণনায় চালক বলেন, হঠাৎ তারা ওঠার পর আমি চেয়ে থাকি। বাসে দুজন উঠেছিল। আমি তাদের চিনতে পারিনি। অনেক মানুষের কারণে কোন দলের তাও বলতে পারছি না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের সামনেই ঘটনা ঘটেছে। দুই পাশেই তো পুলিশ ছিল। আমি পুলিশকে বলারও সুযোগ পাইনি, তারা আগুন দিয়েই চলে গেছে। কিন্তু পুলিশ তাদের লক্ষ্য করেছে নাকি করেনি তা আমি বলতে পারি না। আমি আমার জান বাঁচানো নিয়ে ছিলাম।

এ বিষয়ে রোববার বিকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, পুলিশ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেখানে কাজ করছিল। পুলিশের সামনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে কথাটি সত্য নয়। বরং আমরা বিশৃঙ্খলাকারীদের নিবৃত্ত করতে কাজ করেছি। অপরাধীদের শনাক্তের বিষয়ে এখনো কোনো খবর নেই। তবে অগ্নিসংযোগকারীদের গ্রেফতারে আমরা সচেষ্ট আছি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবিএম নাজমুস সাকিব বলেন, এই কাজটি যারা করেছে তারা কোনো দলের সমর্থক বলে আমি মনে করি না। এরা এক ধরনের ভাড়াটে অপরাধী। যারা অর্থের বিনিময়ে কাজ গুলো করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, তারা প্রশিক্ষিত একটি গ্রুপ।

সাধারণত এ ধরনের অপরাধীরা কোনো অপরাধ সংঘটের পরে তা সঠিক ভাবে সম্পাদন হলো কিনা সেজন্য কিছু এভিডেন্স (প্রমাণ) রাখে। তাদের সঙ্গে যাদের চুক্তি রয়েছে তাদের জন্য প্রমাণ স্বরূপ ভিডিও করে নিয়ে যায়। অনেক বড় বড় অপরাধে এ ধরনের এভিডেন্স রাখার নজির রয়েছে।

এদিকে শুধু মাতুয়াইলের এই আগুনের ঘটনাগুলোই নয়, অন্যান্য ঘটনাগুলো নিয়েও রয়েছে নানা রহস্য। ঢাকার উত্তরায় দাঁড়িয়ে থাকা ঈগল পরিবহণের যাত্রীবাহী একটি বাসে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। শনিবার রাত ১০টার দিকে উত্তরার আকাশ প্লাজা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

যাত্রীবাহী বাসে আগুন লাগার খবর পেয়ে উত্তরা ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ১০ মিনিটের চেষ্টায় আগুন নেভায়। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া শ্যামলীতে পুলিশের গাড়িতে আগুন ও কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার দুপুর ১টার কিছুক্ষণ পর শ্যামলী স্কয়ারের উলটো দিকের সড়কে এ ঘটনা ঘটে।

এদিকে বাস পোড়ানোর ঘটনায় বিএনপিকে দায়ী করে আওয়ামী লীগ নেতারা নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রশ্ন তুলে বলেছেন, বিএনপি কি আবারও সেই অগ্নিসন্ত্রাসের দিকে ফিরে যাচ্ছে? তারা আগুন লাগানোর জন্য উৎসাহ দিচ্ছেন। আমি আহ্বান করব, তারা যেন ২০১৪-১৫ তে জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে যে নৃশংসতা ঘটিয়েছিল, তার যেন পুনরাবৃত্তি না করে।

এ বিষয়ে রোববার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেরা জ্বালাও-পোড়াও করে দায়টা চাপায় অন্যের ওপর। জ্বালাও-পোড়াও কে করছে, কে করে অতীতেও আপনারা দেখেছেন, গতকালও কিভাবে আগুন লাগিয়েছে তা স্বয়ং বাস চালক বলেছেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দশ গজ দূরে ছিল। পুলিশের অবস্থান থাকার পরও কয়েকজন যুবক এসে চালককে বলেছে তুমি নামো, তা না হলে তোমাকেসহ পুড়িয়ে দেওয়া হবে। সামনে পুলিশ থাকলে একজন যুবক কখনও একথা বলতে পারে? অথচ ঠান্ডা মাথায় কাজটি করা হয়েছে। বিরোধী দলের কোনো নেতাকর্মীর তো এমন সাহস পাওয়ার কারণ নেই। কারণ সেখানকার ওই অবস্থার মধ্যে বিএনপির নেতাকর্মীরা এই কাজ করবে তা একেবারেই মূর্খরা ছাড়া কেউ এটা বিশ্বাস করবে না। পাগলও এটা বিশ্বাস করবে না।

শনিবার রাজধানীর মাতুয়াইলেই তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাতুয়াইলের মাতৃসদন হাসপাতালের সামনে দুটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ সময় যাত্রীরা তাড়াহুড়ো করে বাস থেকে নেমে যান। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এসে আগুন নেভান। দুপুর পৌনে ২টার দিকে দক্ষিণ মাতুয়াইলের সান্টু ফিলিং স্টেশনের সামনে আরও একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। দুপুর ২টার দিকে এই বাসের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এই তিনটি ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে আগুনের বিষয়ে নানা ক্লু ও প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়।