স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট: মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মো. মকবুল হোসেনকে চাকরি থেকে অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। এর একদিন যেতে না যেতেই পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার তিন কর্মকর্তাকে ‘জনস্বার্থে’ অবসরে পাঠানো হলো। মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) এ সংক্রান্ত তিনটি আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। শোনা যাচ্ছে, এ তালিকায় আছে আরও অনেক কর্মকর্তার নাম। আর এ নিয়ে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে একরকম তোলপাড় শুরু হয়েছে। কর্মকর্তাদের মধ্যে গুঞ্জন চলছে, এর পর কে? সকলেরই প্রশ্ন হঠাৎ কেন এই সিদ্ধান্ত? কি এমন ঘটল যে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হচ্ছে? নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র বলছে, সরকারবিরোধী কাজে কোন কোন কর্মকর্তা জড়িত সে বিষয়ে খোঁজ নিতে গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
গত রোববার (১৬ অক্টোবর) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে হঠাৎ-ই প্রজ্ঞাপন জারি করে জানানো হয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে অবসরে পাঠানোর খবর। প্রশাসন ক্যাডারের ১০ম ব্যাচের এই কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ স্বাভাবিকভাবে শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজমের সই করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮ এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী জনস্বার্থে তাকে সরকারি চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হলো।’ মকবুল হোসেন পদোন্নতি পেয়ে গত বছরের ৩১ মে সচিব হিসেবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। খোদ তিনিও জানতেন না এমন সিদ্ধান্ত আসবে। গণমাধ্যমকে মকবুল হোসেন বলেছেন, এমন ঘটনার জন্য কোনোরকম প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। এমনকি কোন অপরাধে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলো সেটাও জানেন না তিনি।
এরপর থেকেই প্রশাসনে শুরু হয় তোলপাড়। নিজের কর্মকাণ্ডের হিসাব নিজেই মেলাতে শুরু করেছেন কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ রয়েছেন চরম আতঙ্কে। তাদের প্রশ্ন এরপর কে? আর এই প্রশ্নের ডালপালা ছড়াচ্ছে খুব দ্রুতই। সূত্র বলছে, এই তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে ১২ থেকে ১৪ জন কর্মকর্তার গতিবিধি নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। বিশেষ করে সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সংশ্লিষ্টতা খোঁজা হচ্ছে। যদিও সরকারের অবস্থান থেকে এ বিষয়ে কোনো ধরনের বক্তব্যই দিচ্ছেন না কেউ।
মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) সারাদিন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কেউ-ই এ বিষয়ে মুখতে চাননি। তবে কয়েকজন ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, গলদ শুরু হয় পদোন্নতি থেকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই বলেন, আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্র রাজনীতি করে আসা এবং প্রকৃত অর্থে মেধাবী হওয়ার পরও পদোন্নতির সময় তাদের পেছনেই রাখা হয়েছে। এমনকি গুরুতর অভিযোগ থাকা কর্মকর্তাদেরও সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পরে দেখা যায়, তাদের অনেকেই নীতির বাইরে গিয়ে কাজ করছেন কিংবা কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন। সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ নম্বর ধারায় আছে, কোনো সরকারি কর্মচারির চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময় সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় মনে করলে কোনো কারণ না দর্শিয়ে তাকে চাকরি থেকে অবসর প্রদান করতে পারবে। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ; সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে।
তথ্য সচিবের প্রজ্ঞাপনের একদিন পরেই পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার তিন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে আলাদা তিনটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রজ্ঞাপনে সই করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগেন সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন। অবসরে পাঠানো তিন পুলিশ কর্মকর্তা হলেন- পুলিশ সদর দফতরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শহীদুল্ল্যাহ চৌধুরী, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পুলিশ সুপার মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা এবং মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জারি করা এ প্রজ্ঞাপন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। নানা সূত্র থেকে শোনা যাচ্ছে, এই তালিকায় আরও অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন। যদিও এ প্রসঙ্গে দায়িত্বশীল কেউ মুখ খুলছেন না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আলী আজমকে কয়েকবার ফোন করার পর পাওয়া গেলেও এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি। তিনি শুধু বলেন, ‘নো কমেন্টস।’
বিষয়টি নিয়ে ফোন করা হয় সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদারকে। তিনি বলেন, আইনে এ রকম বিধান রয়েছে। আমার মনে হয় না তার লঙ্ঘন হয়েছে। এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না।
উল্লেখ্য, সরকারি কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো কিংবা যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। বিএনপি সরকারের সময়েও এমন ঘটনার নজির রয়েছে। আবার বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুর দিকে ২০০৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হেয় করে কবিতা লেখার অভিযোগে তৎকালীন তথ্য সচিব আ ত ম ফজলুল করিমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। এরপর ২০১৪ সালে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার কারণে পাঁচ সচিবকে একসঙ্গে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছিল সরকার।
আপনার মতামত লিখুন :