বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকাঃ প্রথম পর্যায়ের কোভিড ভ্যাকসিন কাদের দেওয়া হবে, তার তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। শুরুতে ডাক্তার ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী, এরপর ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বেক্সিমকো ফার্মাসিউট্যাকলসের মাধ্যমে ভারতের সিরাম ইন্সটিউটের কাছে থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগের ‘কোভিডশিল্ড’ টিকা সংগ্রহ করবে সরকার।
সিরামের কাছ থেকে বাংলাদশে প্রথম পর্যায়ে পাবে ৩ কোটি ডোজ টিকা। জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে এই ভ্যাকসিন পাওয়ার আশা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রতি জনকে দুই ডোজ করে ভ্যাকসিন দিতে হবে, তাতে প্রথম দফায় দেড় কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হবে। এই টিকা যাদেরকে দেয়া হবে তার তালিকা তৈরি করা হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে। এ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাজ করছে।
তালিকা তৈরির জন্য গঠন করা উপজেলাভিত্তিক ভ্যাকসিন কো-অর্ডিনেশন কমিটি মাইক্রোপ্লানিংয়ের কাজ শুরু করেছে। ভ্যাকসিন দেশে আসার পর ওয়ার্ড পর্যায়ে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা তালিকাভূক্তদের নির্ধারিত দিনে ভ্যাকসিন দেবেন। ভ্যাকসিন কেনার পর তার কোল্ড চেইন নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া থেকে শুরু করে মানবদেহে ভ্যাকসিন পুশ করা পর্যন্ত যাবতীয় কাজের ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পৃথক একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগিদের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ণ হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য) মো. মোস্তফা কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ভ্যাকসিনের কোল্ড চেইন বজায় রাখতে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। অগ্রাধিকারভিত্তিতে যারা ভ্যাকসিন পাবেন, ওয়ার্ড পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে তাদের তালিকা প্রণয়ন করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তালিকা প্রণয়নে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর কোনো সুযোগ নেই বলে তিনি জানান।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যেই সিভিল সার্জনদের মাধ্যমে সারাদেশে কর্মরত সরকারি চাকরিজীবীদের একটি তালিকা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এখন ৬০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা জন্ম তারিখ এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হবে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, গত মাসে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক, প্রশাসন, সিটি করপোরেশনে কর্মীদের তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমাদের কাছে চাওয়া হয়েছে। বয়স ভেদে কোন তালিকা আমাদের কাছে এখনো চায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তালিকা প্রণয়নের পর নির্বাচন কমিশনের ডাটাবেজের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখার পর কাকে কবে ভ্যাকসিন দেয়া হবে তার দিন তারিখ উল্লেখ করে প্রত্যেককে একটি স্লিপ দেয়া হবে।
তবে ১৮ বছরের কম বয়সী কেউ আপাতত ভ্যাকসিন পাবেন না বলে জানিয়েছেন সরকারের কোভিড-১৯ বিষয়ক টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি কমিটির মেম্বার প্রফেসর নজরুল ইসলাম। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম দফার ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে চুক্তি করেছে সরকার। টিকার মোট মূল্যের অর্ধেক, ৬৩৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা সিরাম ইনস্টিটিউটকে অগ্রিম পরিশোধ করতে ছাড় করেছে অর্থমন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান, ওয়ার্ডবয়সহ হাসপাতালের ভেতরে কাজ করেন এমন সবাইকে সবার আগে ভ্যাকসিন দেয়া হবে। এর পরেই পাবেন ৬০ বছরের বেশি বয়সীরা। তারপর পাবেন পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য এবং ফ্রন্টলাইনার হিসেবে কর্মরত সরকারের বিভিন্ন সংস্থার জনবল ও সাংবাদিকরা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের জুলাইয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৩৬ লাখ ৫৩ হাজার। পুলিশ, সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ দেশে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ডোজপ্রতি ভ্যাকসিনের কোল্ডচেইন নিশ্চিত করতে খরচ হবে ১.২৫ ডলার। এই হিসাব ধরে প্রথম দফায় পেতে যাওয়া তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের জন্য কোল্ডচেইন নিশ্চিত করতে অর্থমন্ত্রণালয়ের কাছে ৩১৮ কোটি টাকা চেয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ পর্যন্ত পেয়েছে ১০০ কোটি টাকা। কোল্ডচেইন ব্যবস্থাপনা, প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনা, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, তালিকা প্রণয়নসহ টিকা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ বাস্তবায়নে যে প্রকল্প নেয়া হচ্ছে, তাতে অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা।
৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্ব্যব্যাংকের ১০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তায় চলমান ‘কোভিড-১৯ ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ শীর্ষক প্রকল্পে বাড়তি অর্থায়ন বাবদ এ সহায়তা আসবে বলে জানান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) বিশ্বব্যাংক উইং প্রধান ও অতিরিক্ত সচিব শাহাবুদ্দীন পাটওয়ারী।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সূত্র জানায়, সংস্থাটি চলতি অর্থবছর বাংলাদেশকে বাজেট সহায়তা বাবদ মোট ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেবে। এর মধ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার আসবে ‘বাংলাদেশ প্রোগ্রাম্যাটিক জবস ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিট’ শীর্ষক চলমান কর্মসূচীর তৃতীয় কিস্তি হিসেবে।
বাংলাদেশ প্রোগ্রাম্যাটিক রিকোভারি অ্যান্ড রেসিলিয়ান্স’ শীর্ষক সম্পূর্ণ নতুন একটি কর্মসূচীর আওতায় নতুন ২৫০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। শাহাবুদ্দিন পাটওয়ারী জানান, বাজেট সহায়তার জন্য প্রাপ্ত অর্থ সরকার ভ্যাকসিন কেনা হব।
এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ও জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা (জাইকা) থেকে ভ্যাকসিন কেনায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার করে পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করছেন ইআরডির যুগ্ম সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী। এ ছাড়া জার্মানি ও ফ্রান্সের কাছে দ্বিপাক্ষিক সহায়তা বাবদ ২৫০ মিলিয়ন ডলার করে মোট ৫০০ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :