
বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকাঃ বিদেশ থেকে যাত্রীবাহী বাস কিনতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। তার চেয়েও বড় কথা আমদানি প্রক্রিয়ায় অন্তত তিন থেকে চার বছর সময় লাগে। এ সব ঝামেলা এড়িয়ে সাশ্রয়ে যাত্রীসেবা দিতে দেশেই বাস তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। প্রাথমিকভাবে ডিজেলচালিত একতলা বাস তৈরি করবে সংস্থাটি। এর অংশ হিসেবে এরই মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
বিআরটিসি সূত্রে জানা গেছে, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে চেসিস সংগ্রহ করে বাস তৈরি করবে বিআরটিসি। এ জন্য সরবরাহকারীদের কাছে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চেসিস সংগ্রহ করে বাস তৈরির বাকি কাজ করবে করপোরেশনের টেকনিশিয়ানরা। এতে সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে।
এ বিষয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাস তৈরির উদ্যোগটি এখন বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। প্রতি মাসে অন্তত ১০টি বাস তৈরির টার্গেট রয়েছে। বিআরটিসির দক্ষ প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানরা মিলে এসব বাস তৈরি করবেন। যাত্রীদের জন্য আরামদায়ক বিবেচনা করে এগুলো তৈরি করা হবে। এতে অনেক সাশ্রয় হবে। আগামী মাস থেকে বাস তৈরির কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি।
পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার উদ্যোগী হলেই বেসরকারি পরিবহন খাতের একটি চক্র অপতৎপরতা চালায়। যত্রতত্র বাস থামানোর দাবিতে আন্দোলনেরও নজির আছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি যাত্রীসেবায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বাস ক্রয় ও মেরামতের নামে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই অবস্থা বর্তমানে অনেকটা কেটেছে। এবার শুধু চেসিস আমদানির পর নিজস্ব কারখানায় বাস তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বিআরটিসি।
১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত বিআরটিসি দীর্ঘদিন লোকসান গুনেছে। এরপর ২০২১ সালের পর থেকে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে। তার আগে কেনাকাটা ও রক্ষণাবেক্ষণে অনিয়ম এবং গাফিলতিতে লোকসান গুনতে হয়েছে বিআরটিসিকে। ফলে সাশ্রয়ের বিষয়টি মাথায় রেখে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে নিজস্ব কারিগর দিয়ে গাজীপুর ও তেজগাঁওয়ে গাড়ি প্রস্তুত করা হবে। তা ছাড়া সাধারণত প্রকল্পের মাধ্যমে গাড়ি আমদানি করতে হলে ডিপিপি অনুমোদন, চুক্তিসই ও সরবরাহ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ন্যূনতম ৩ বছর লাগে। আর প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক গাড়ি একত্রে আনা গেলেও বৈদেশিক সুদ পরিশোধ করতে হবে। আমদানি খরচও বেশি। এখন কেবল চেসিস আমদানি করে বিআরটিসি দেশে বসে গাড়ি তৈরি করবে। এতে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশ থেকে একটি সাধারণ বাস আমদানি করতে হলে গড়ে খরচ পড়ে ১ কোটি ১২ লাখ ৬০০ টাকা। এর মধ্যে ইউনিট মূল্য ৬৬ হাজার ডলার। রয়েছে ৩৫ শতাংশ সিডি/ভ্যাট ও ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি। সবমিলে ৯৫ হাজার ৭০০ ডলার। সে হিসাবে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। আর নিজস্ব ওয়ার্কশপে বাস প্রস্তুত করলে খরচ হবে অনেক কম। যেমন-অশোক লিল্যান্ড বাসের ইঞ্জিনসহ চেসিসের দাম ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর বাসের সম্পূর্ণ বডি তৈরি ও অন্যান্য মালামাল বাবদ খরচ ৮৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। হিনো ওয়ান জে বাসের ইঞ্জিনসহ চেসিস মূল্য ৫৩ লাখ টাকা। বাসের সম্পূর্ণ বডি তৈরি ও অন্যান্য মালামাল বাবদ খরচ ৪০ লাখ টাকা। সবমিলে ৯৩ লাখ টাকা। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত একটি অত্যাধুনিক এসি বাসের ক্রয়মূল্য ২ কোটি ৩৯ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ইউনিট মূল্য ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার, ৩৫ শতাংশ সিডি/ভ্যাট-৪৯ হাজার ও ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ১৪ হাজার ডলার। আর এ ধরনের বাস বিআরটিসির নিজস্ব ওয়ার্কশপে খরচ হবে ৯৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর মধ্যে এসি বাসের ইঞ্জিনসহ চেসিসের মূল্য ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা, বাসের সম্পূর্ণ বডি তৈরি ও অন্যান্য মালামাল বাবদ খরচ ৪৮ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিআরটিসিতে গাজীপুরের সমন্বিত কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানা (আইসিডব্লিউএস) এবং কেন্দ্রীয় মেরামত কারখানায় (সিডব্লিউএস) বড় ওয়ার্কশপ শেড আছে। সেখানে ইঞ্জিন ওভারহলিং, মেশিনশপ এবং গাড়ির বডি তৈরির কাজ করা সম্ভব। করপোরেশনের ওয়ার্কশপগুলোয় ডেন্টিং, পেইন্টিংসহ ওয়ার্কশপ সংশ্লিষ্ট সব কাজের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম আছে। রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও কারিগর।
বিআরটিসি জানিয়েছে, সাধারণত ৪৫ আসনের একটি গাড়ির ক্রয়মূল্য ১ কোটি টাকা। ঢাকা-কুমিল্লা রুটে বাসটি চলাচল করে দেড় ট্রিপ দেয় প্রতিদিন। মাসিক আয় ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ টাকা। বছরে আয় ৯৫ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ টাকা। আর আনুমানিক মাসিক গড় ব্যয় ৫ লাখ ৮৩ হাজার ৪৩০ টাকা। এর মধ্যে জ্বালানি, লুব্রিকেন্ট, যন্ত্রাংশ, টায়ার, ভারী মেরামত, টোল/ফেরি, বেতন-ভাতা যুক্ত। আর বাৎসরিক আয়-ব্যয় ৭০ লাখ ১ হাজার ১৬৭ টাকা। এক বছরের নিট লাভ হিসাব করলে আয় ৯৫ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ টাকা আর ব্যয় ৭০ লাখ ১ হাজার ১৬৭ টাকা। অর্থাৎ, এক বছর অপেক্ষা করে নিট লাভ হবে ২৫ লাখ ২৪ হাজার ৪৩২ টাকা। ১ কোটি টাকা নিট লাভ করতে লাগবে চার বছর।
আপনার মতামত লিখুন :