মোঃ রাসেল সরকার, ঢাকাঃ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন ও ক্ষমতাসীনদের বিদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে আসা বিএনপির নজর এখন ঢাকায়। দলটির নীতিনির্ধারকদের মতে, আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজধানী। তাই এবার চূড়ান্ত আন্দোলন হবে ঢাকা ঘিরেই। সে লক্ষ্যে রাজধানীতে সংগঠনকে শক্তিশালী এবং পোক্ত করতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে দলের হাইকমান্ড। তারা মনে করছেন, চলমান আন্দোলনে ঢাকা মহানগরীর নেতাদের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। কেননা আন্দোলনের কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তোলার বিষয়টি নির্ভর করছে ঢাকার আন্দোলনের ওপর।এরই মধ্যে রাজধানীতে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির নির্দেশনায় নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। দলের নেতারা জানান, যে কোনো সময়ের চেয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি এখন যথেষ্ট শক্তিশালী। তাদের ওপর ভিত্তি করেই আন্দোলনে যাওয়া যেতে পারে। তবে মহানগর বিএনপির সক্ষমতা নিয়ে আরও নিশ্চিত হতে চাচ্ছে হাইকমান্ড। চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে আরেকটি মহড়া দিয়ে পরীক্ষা নিতে চান তারা।
এদিকে আন্দোলনের রোডম্যাপ চূড়ান্তের আগে যুগপতের শরিক দল ও জোটের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। গতকাল বৃহস্পতিবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এই বৈঠকে বিভেদ ভুলে সংগঠনকে আরও মজবুত এবং নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখার নির্দেশনা দেন তিনি। এর আগে সাড়ে তিন হাজার ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। সবার মতামত বিশ্লেষণ করে আন্দোলনের প্রথম দফার কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এ দফায় ঢাকা থেকে বিভাগীয় শহরে রোডমার্চ করার পক্ষে প্রায় সবাই মত দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ঢাকা মহানগরী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় কর্মসূচি সফলের দায়িত্ব থাকে ঢাকার নেতাদের ওপর। তবে প্রায় ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির ঢাকায় সাংগঠনিক শক্তি কিছুটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিনের পোড়খাওয়া বেশ কজন প্রভাবশালী নেতা দায়িত্বে থাকলেও বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে তেমন কার্যকর ভূমিকা দেখাতে পারেনি ঢাকা মহানগর বিএনপি। তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও এ বিষয়ে অসন্তুষ্ট। তাদের অভিযোগ, ঢাকার নেতাদের ব্যর্থতার কারণেই দেশব্যাপী জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। ফলে ঢাকা মহানগর বিএনপি নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করে হাইকমান্ড।
২০১৪ সালের পর থেকে মহানগর বিএনপির নেতৃত্বে বেশ কয়েকবার রদবদল এনেও সুফল মেলেনি। ২০১৭ সালে ঢাকা মহানগরকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করে দুটি কমিটি করা হয়; কিন্তু তাতেও আশানুরূপ ফল আসেনি। অবশেষ ২০২১ সালের আগস্টে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা আমান উল্লাহ আমানকে আহ্বায়ক করে ঢাকা উত্তর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালামকে আহ্বায়ক করে ঢাকা দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। উত্তরের কমিটিতে সদস্য সচিব করা হয় জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হককে এবং যুবদলের সাবেক নেতা রফিকুল ইসলাম মজনুকে দক্ষিণের সদস্য সচিব করা হয়। ঢাকা মহানগরীর নেতাকর্মীরা জানান, এই কমিটির নানা তৎপরতায় আগের তুলনায় ঢাকায় বিএনপির আন্দোলন এখন কিছুটা হলেও চাঙ্গা হয়েছে। চূড়ান্ত আন্দোলনে তারা কতটুকু সফল হবে, এখন সেই অপেক্ষা। অবশ্য ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের শীর্ষ নেতারা জানান, ঢাকায় আন্দোলন চাঙ্গা করতে দলের ত্যাগী-সক্রিয় নেতাকর্মীদের পদায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যারা দক্ষ ও আন্দোলন-সংগ্রাম জমাতে পারবেন; তাদেরকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে থানা ও ওয়ার্ড কমিটিগুলোতে। বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ঢাকায় অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোকেও সক্রিয় করে তোলা হবে।
এদিকে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে গত ২৫ এপ্রিল ঢাকা মহানগর উত্তরের সব থানার আহ্বায়ককে লিখিতভাবে সাংগঠনিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে ঢাকা মহানগর উত্তরের অন্তর্গত সব থানার আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়কদের আগামী ১৫ দিন তথা ১০ মের মধ্যে নিজ নিজ থানার নিষ্ক্রিয় ইউনিট কমিটি পুনর্গঠন, ওয়ার্ড কমিটির নিষ্ক্রিয় নেতাদের তালিকা তৈরি করে সক্রিয় নেতাদের দিয়ে পূরণ করার প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নিতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা সাংগঠনিক জোনাল টিম এবং মহানগর উত্তর বিএনপির নেতাদের থেকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ নেবেন। সেইসঙ্গে সব ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে থানা আহ্বায়ক কমিটি এবং জোনাল টিমকে সার্বিক সহযোগিতা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান ও সদস্য সচিব আমিনুল হক এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন।
এ প্রসঙ্গে আমান উল্লাহ আমান বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে বিএনপি ও সমমনা দল এবং জোটগুলো যুগপৎ আন্দোলনের যে কর্মসূচি ঘোষণা দেবে, সেটা সফল করতে আমরা প্রস্তুত এবং সফলও হবো ইনশাআল্লাহ। গত জানুয়ারিতে ঢাকায় পদযাত্রা, মানববন্ধন ও সমাবেশে সেই প্রমাণ মিলেছে। তিনি বলেন, উত্তরের ৭১ ওয়ার্ডে এরই মধ্যে বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। গত ২৫ জানুয়ারি উত্তরের ২৬ থানায় আহ্বায়ক কমিটিও করা হয়েছে। তৃণমূলকে সঠিকভাবে সাজাতে প্রতিটি কমিটির আহ্বায়কসহ তিনজনকে স্বাক্ষরের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কমিটির নেতাদের দ্রুত নিজ নিজ থানায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির অধীনে সাংগঠনিক থানা ২৪টি, ওয়ার্ড ৮০টি। আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর সম্মেলনের মাধ্যমে ৬০টি ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটি এবং ২০টিতে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। ২৪টি থানায় আহ্বায়ক কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলমান।
ঢাকা দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু বলেন, সব বিভেদ ও মান-অভিমান ভুলে নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। কিছু বিষয়ে গ্যাপ আছে। সেগুলো পূরণের চেষ্টা চলছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই বাকি কমিটিগুলো ঘোষণা করা হবে।
বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ বলেন, সাধারণত আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হলো রাজধানী। এজন্য আমরা ঢাকাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। অতীতের ব্যর্থতা ঘোচাতে নবোদ্যমে কাজ শুরু করেছে হাইকমান্ড। আন্দোলনের জন্য রাজধানীতে সংগঠনকে একেবারে তৃণমূল থেকে সংগঠিত করার পরিকল্পনা রয়েছে দলের। সেই কাজ শেষ পর্যায়ে।
আপনার মতামত লিখুন :