
মোঃ রাসেল সরকারঃ গত তিন দিন ধরে সারাদেশে চলছে অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের বিরুদ্ধে অভিযান। এমন অভিযানে সাধারণ জনগণ উপকৃত হলেও দিন-কয়েক পরেই দেখা মেলে ‘পুরনো চিত্র’। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করেই চলছে এমন রমরমা বাণিজ্য— অভিযোগ সেবা নিতে আসা ভুক্তভোগীদের। ফলে বাণিজ্যের আড়ালে বেশ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের স্বাস্থ্যসেবা— এমনটা যথেষ্ট অনুমেয়।
সারাদেশের মতো খোদ ঢাকার অলিগলিতেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্লিনিক-হাসপাতাল। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া চলমান এসব ডায়াগনস্টিক, ক্লিনিক বা হাসপাতালের বেশিরভাগের চিকিৎসার মান নিয়ে আছে এন্তার অভিযোগ। রাজধানীর চানখারপুল, গ্রিন রোড, মুগদা, মিরপুর, কলেজগেট, বাড্ডা এলাকাতে রয়েছে এ ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কেবল কলেজগেট ও শ্যামলী এলাকাতেই রয়েছে বৈধ-অবৈধ অর্ধশতাধিক ক্লিনিক-হাসপাতাল।
এদিকে, কলেজগেট ও আগারগাঁও এলাকায় রয়েছে সরকারি বেশ কিছু হাসপাতাল। যার মধ্যে রয়েছে পঙ্গু, শিশু, নিউরোসায়েন্স, সোহরাওয়ার্দী, মানসিক, নাক কান গলা হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনিস্টিটিউট। সরকারি হাসপাতালের রোগীদের টার্গেট করেই মূলত আশপাশে গড়ে ওঠা এসব ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকগুলোতে অহরহ ভুল চিকিৎসা বা অপচিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালের সেবার মান, ভর্তির নানান ঝামেলা; সিট না পাওয়া, ঠিকমত ডাক্তার না পাওয়াসহ বিভিন্ন অজুহাতে ‘সর্বদা সচেষ্ট’ দালালের খপ্পরে পড়েন ঢাকার বাইরে থেকে আসা বেশিরভাগ মানুষ। রোগী বা সঙ্গে থাকা স্বজনদের সুচিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে দালালরা আশপাশের নামসর্বস্ব হাসপাতালে কমিশনের বিনিময়ে ভর্তি করে উধাও হয়ে যায়।
অতীতে এই এলাকায় অবস্থিত নিবন্ধন না থাকা অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশও জারি হয়েছে উচ্চ আদালত থেকে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে সঠিক মনিটরিং না থাকায়, পরবর্তী সময়ে এসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিয়ে ফের চালু করেছে। ফলে সেবার নামে এদের মাধ্যমে সর্বস্ব খুইয়ে প্রতারিত হচ্ছেন অনেক সাধারণ রোগী। কথিত হাসপাতাল-ক্লিনিকের রমরমা বাণিজ্যের ফাঁদে পড়ে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের। অর্থ সম্পদের সঙ্গে কেউ কেউ জীবনও হারাচ্ছেন।
রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা গরিব রোগীদের দালালের মাধ্যমে ভাগিয়ে নিয়ে ফাঁদে ফেলে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করছে এই এলাকার ডায়াগনস্টিক-ক্লিনিকগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো রোগীর জন্য পুরোপুরি ‘দালাল নির্ভর’। নগদ টাকার বিনিময়ে এরা নির্ধারিত দালদের কাছ থেকে রোগী বুঝে নেন। রোগী তো নয়, যেন পণ্য বিনিময়!
উল্লেখ্য, অপচিকিৎসায় রোগী মারা যাওয়ার অভিযোগে ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ রাজধানীর কলেজগেট এলাকার লাইসেন্সবিহীন ১৪টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশ দেন। সেসময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ লাইসেন্সসহ বিভিন্ন কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দ্রুত এই নির্দেশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন আদালত।
কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এদের অধিকাংশই নতুন করে আবারো নিবন্ধন নিয়ে সচল রেখেছে তাদের ব্যবসা। তখন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল- ক্রিসেন্ট হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স, বিডিএম হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স, সেবিকা জেনারেল হাসপাতাল, জনসেবা নার্সিং হোম, লাইফ কেয়ার নার্সিং হোম, রয়্যাল মাল্টি স্পেশালিটি হসপিটাল, শেফা হসপিটাল, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা মেন্টাল হসপিটাল, মনমিতা মেন্টাল হসপিটাল, প্লাজমা মেডিক্যাল সার্ভিস অ্যান্ড ক্লিনিক, ইসলামিয়া মেন্টাল হসপিটাল, মক্কা-মদিনা জেনারেল হাসপাতাল, নিউ ওয়েল কেয়ার হসপিটাল ও বাংলাদেশ ট্রমা স্পেশালাইজড হসপিটাল।
আদালতের নির্দেশের পর সেসময় অ্যাড. মনজিল মোরসেদ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আইন অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া হাসপাতাল পরিচালনা অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কারণ হাসপাতালের সঙ্গে মানুষের জীবন-মৃত্যুর সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে ওইসব বেআইনি হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে গত ৯ সেপ্টেম্বর রিট আবেদন করা হয়।
সোমবার (৩০ মে) সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোড, বাবর রোড ও খিলজি রোডের আশপাশে অসংখ্য নামসর্বস্ব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। রাস্তা ধরে হাঁটতেই নানান নামের হাসপাতালের বিলবোর্ড। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে, প্রায় প্রতিটা হাসপাতাল-ক্লিনিকই সচল। মোটামুটি রোগীর উপস্থিতিও বেশ। রোগীদের উপস্থিতি দেখলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘রাজধানীর বাইরে থেকে আশা রোগীরা এসব হাসপাতালের খোঁজ পান কেমন করে?’
বগুড়ার শেরপুর থেকে শ্যালকের চিকিৎসার জন্য রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এসেছিলেন আলমগীর হোসেন। হাসপাতালে ঢোকার পর দালালের ফাঁদে পড়ে ভাইকে ভর্তি করান একটি বেসরকারি ক্লিনিকে। তিনি বলেন, ভাইকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এসেছিলাম। কিন্তু আসার পর একজন আমাদের বলেন, ‘এখানে চিকিৎসা ভালো হয় না, সরকারি হাসপাতাল— এজন্য ডাক্তার গুরুত্ব দিয়ে দেখে না’। এর থেকে ভালো চিকিৎসা হবে বলে তিনি আমাদের প্রাইভেটে এই ক্লিনিকে নিয়ে আসেন। তারপর থেকে এখানেই চিকিৎসা করাচ্ছি। কিন্তু ভাইয়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি দেখছি না। ইতোমধ্যে ২৫-৩০ হাজার টাকা শেষ।
আলমগীরের মতো এমন অভিযোগ করেছেন আরো কয়েকজন। অভিযোগে তারা বলেন, এক শ্রেণীর দালাল সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আশপাশের ক্লিনিকে নিয়ে আসলেই মোটা অঙ্কের কমিশন পেয়ে থাকেন। যেটা পরবর্তীতে চিকিৎসার ব্যয়ের সঙ্গে রোগীদের কাঁধে চাপানো হয়।
এসব প্রতিষ্ঠানে অনেকে ডাক্তার না হয়েও পরিচয় গোপন রেখে রোগীদের চিকিৎসা দেন। এ ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানে নার্স বা ওয়ার্ডবয় রোগী দেখেন বলেও জানান বাবর রোডের বাসিন্দা মইনুল ইসলাম।
আপনার মতামত লিখুন :