নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্রী তুর্ণা, গার্মেন্টস পণ্য সরবরাহকারী উদ্যোক্তা হিসেবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সাফল্য মেলে হাতের মুঠোয়। পড়ালেখা শেষ না হতেই ১৫/২০ জন শ্রমিক নিয়ে একটি কারখানাও চালু করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে ওঠেন আইডল। সফল উদ্যোক্তা হিসেবে বেশ কয়েকটি টকশোতেও অংশগ্রহণ করেন তিনি। এরপর থেকেই বড় হওয়ার কুৎসিত লালসা চেপে ধরে তাকে। নিজের সফলতাকে পেরিয়ে সফলতার আরো উচ্চ শিখরে উঠতে গা ভাসাতে থাকেন প্রতারনা জগতে, যোগ দেন নাইজেরিয়ান কিছু প্রতারক চক্রের দলে। এই চক্রের প্রধান হিসেবে কাজ করতেন তুর্ণা, বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিত হয়ে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। আর এসব প্রতারণার অভিযোগেই গত বছর কয়েকজন প্রতারক নাইজেরিয়ান নাগরিকের সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এমন প্রতারক ব্যক্তি ও গ্রুপের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। সোশ্যাল মাধ্যমের বদৌলতে অনলাইন দুনিয়ায় বেকারত্ব দূর করনের আশায় লাখ লাখ উদ্যোক্তা যেমন গড়ে উঠছে তেমনি গড়ে উঠেছে অসংখ্য প্রতারক চক্র।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক জুড়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নাম সহ নারী উদ্যোক্তা, অমুক তমুক গ্রুপের নামে ভুঁইফোড় অসংখ্য উদ্যোক্তা গ্রুপ গড়ে উঠেছে সোশ্যাল দুনিয়ার অলিগলিতে। তাদের নেই কোনো নীতিমালা ও নিবন্ধন। তবুও ভুরি ভুরি এমন গ্রুপের বিরুদ্ধে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে প্রতিনিয়তই। এসব প্রতারক চক্র বিভিন্ন গ্রুপ তৈরী করে সোশ্যাল মাধ্যমে মার্কেটিং করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের গ্রুপে যুক্ত করে এবং পরবর্তীতে ওইসব উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন রকমের পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেখিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মাঝে আগে নিজেদের বিশ্বস্থতা তৈরি করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন সহ কৌশলে ইনিয়ে-বিনিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ও উদ্যোক্তাদের নিজ নিজ পণ্য থেকে গিফট চেয়ে নেয়া, বিভিন্ন সেলিব্রেটিদের নাম করে এসব দামী পণ্য ও গিফট আইটেমে হাতিয়ে নিয়ে রিভিউ না দিয়ে প্রতারণার অভিযোগও রয়েছে।
তেমনি “উদ্যোক্তা মেলা” নামক একটি ফেসবুক গ্রুপের বিরুদ্ধে বেশ কিছু প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। “উদ্যোক্তা মেলা” গ্রুপের পরিচালনায় থাকা কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের সেলস বাড়ানো, দেশের নামকরা সেলিব্রিটিদের দিয়ে তাদের পেইজের রিভিউ প্রদান করা এবং বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করার নাম করে শত শত উদ্যোক্তাদের থেকে থেকে দুই থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং পণ্য সামগ্রী সহ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
অনেকের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে রিভিউ প্রদান না করে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে যাচ্ছিল ওই গ্রুপটির পরিচালনায় থাকা মাহমুদা জান্নাত নিশি ও আরিফুল ইসলাম নামক দুই পরিচালক। পরবর্তীতে উদ্যোক্তারা তাদের টাকা ফেরত চাইলে তাদের অনেককেই বিভিন্ন রকমের হুমকি-ধামকি দিতেন তারা। পরিচালনাকারী একজন আরিফুর রহমান অনলাইন জগত ও মোটিভেশন এক্সপার্ট হিসেবে উদ্যোক্তাদের নিকট পরিচয়দানকারী মূলত মাহমুদা জান্নাত নিশি ও আরিফুল ইসলাম ওই অভিযুক্ত গ্রুপের এডমিন হিসেবে পরিচিত।
উদোক্তা মেলা গ্রুপের এসব প্রতারণার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক উদ্যোক্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানলে তাদেরকে উকিল নোটিশ দিয়ে মামলার ভয়-ভীতি দেখিয়ে যাচ্ছেন উদ্যোক্তা মেলা গ্রুপের দুই এডমিন। গ্রুপের প্রচারণার বিরুদ্ধে কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে উকিল নোটিশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
যা পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে হয়রানির সামিল বলে মতামত দিয়েছেন এডভোকেট জহিরুল ইসলাম সব কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
উদ্যোক্তা মেলা গ্রুপের পরিচালনায় থাকা মাহমুদা জান্নাত নিশি ও আরিফুল উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে নগদ অর্থ এবং বিভিন্ন মডেল/ সেলিব্রিটিদের দিয়ে পোশাক ও অন্যান্য বিক্রয় সামগ্রী প্রদান করার কথা বলে টাকা ও পন্য গ্রহণ করেছেন এমন বেশ কিছু মেসেঞ্জার ও ভয়েস কথোপকথনের তথ্য প্রতিবেদকে কাছে প্রদান করেছেন ভুক্তভোগীরা।
এমন প্রতারনার বিষয়টি উদ্যোক্তাদের মাঝে জানাজানি হলে অনেকের টাকা ফেরত দিয়েছেন এবং অন্যান্যদের ফেরৎ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানা গেছে। অনেকে টাকা বুঝে পেয়েছে বলে ফেসবুক পোস্ট করেছেন। আবার কেউ উকিল নোটিশ ও মামলার ভয়ে ফেসবুক থেকে তাদের প্রতিবাদের পোস্ট ডিলিট করে দিয়েছেন।
উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করেন এমন একজন উদ্যোক্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, সামাজিক মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করতেই অসংখ্য উদ্যোক্তা খুব অল্প পুঁজি নিয়ে কাজ শুরু করেন। এদের অধিকাংশ উদ্যোক্তাদের মূলধন ৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কিছু কিছু ব্যক্তি ও গ্রুপ এসব উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সাফল্যের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেন এমন ঘটনা ঘটেছে, সহজ সরল ও সফলতা পেতে মরিয়া এসব উদ্যোক্তারা অনায়াসেই এসব প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে যায়। তিনি বলেন এসব গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রশাসনের শিগগিরই পদক্ষেপ নেওয়া এবং নীতিমালা তৈরি করা উচিত।
উল্লেখ্য তাদের প্রতারণার বিরুদ্ধে ফেসবুক সরব হওয়া কয়েকজনকে মামলার ভয় দেখিয়ে এবং আদালতের মতোই কিছু নির্দেশনা জারি করে একটি উকিল নোটিশ সোশ্যাল মাধ্যমে ভাইরাল করেছে ওই ফেসবুক গ্রুপের কর্তারা।
উকিল নোটিশ পাঠানোর স্বত্বাধিকারী আইনজীবীকে এবিষয় মুঠোফোনে জানতে চাওয়া হয়, প্রতারণার প্রতিবাদ করলে উকিল নোটিশ দেয়া কতটা যৌক্তিক? এবং উকিল নোটিশে যেমন অপরাধ উল্লেখ করা হয়েছে তা প্রমাণ না হওয়া কোন ব্যক্তি কে মহামান্য আদালতের নির্দেশের মতোই নির্দেশনা দেয়া যায় কিনা? এসব বিষয়ে আইনজীবী সুমন মিয়ার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তার মক্কেলগণ যা বলেছেন সেই অনুযায়ী লেখা হয়েছে। এবং নির্দেশনার নয় অনুরোধ করেছেন তবে অনুরোধ শব্দটি উল্লেখ না করা ভুল হয়েছে তিনি বলেন ওইদিন তিনি ছিলেন না অন্য একজন এই নোটিশ ড্রাফট করেন, জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে ওই গ্রুপের পরিচালনায় সহযোগিতায় থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, তিনি দায়িত্ব থাকা অবস্থায় এমন বেশকিছু উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সেলিব্রিটিদের রিভিউ দেয়ার কথা বলে টাকা নেয়া হয়েছে এমন অসংখ্য অভিযোগ তার নিকট আসতে থাকে তিনি এডমিনদের বিষয়টি জানালে গ্রুপের এডমিন নিশি হামিদ সহ অন্যান্যরা তার উপর ক্ষিপ্ত হন।
এসব অনৈতিক অর্থ আদায় ও প্রতারণার অভিযোগের বিষয়ে যারা সোশ্যাল মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছে তাদের উকিল নোটিশ ও মামল ভয়ে বাধ্য হয়েছেন তাদের প্রতিবাদ স্বরুপ পোস্ট রিমুভ করে তাদের গুনকীর্তন করে নতুন পোস্ট দিতে।
এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেকেই গৃহবধূ শিক্ষার্থী ও বেকার কর্মসংস্থান অসফলতার স্বপ্নে বিভোর এমন উদ্যোক্তাদের টার্গেট করে মূলত গ্রুপটি প্রোগ্রাম ও লোভনীয় আশ্বাস দিয়ে থাকেন বিক্রয় বাড়াতে এসব আসলে সত্যি মনে করেন তারা। প্রায় ৯০ হাজার সদস্য যুক্ত ওই গ্রুপে যেকোনো অফার বা আশ্বাসের ক্ষেত্রে কতজন অর্থ প্রদান করেছেন তার সঠিক কোন হিসাব কারো জানা নেই জেটি প্রতারণার বিষয়ে গভীর সন্দেহের অবকাশ রয়েছে বলেও ধারণা করেন ভুক্তভোগীরা।
উদ্যোক্তা মেলা গ্রুপের এডমিন মাহমুদা জান্নাত নিশির মুঠোফোনে এসব অনৈতিক ভাবে অর্থ আদায় ও প্রতারণার অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে অন্য আরেকটি নাম্বার থেকে প্রতিবেদক এর নিকট ফোন আসে তিনি মাহমুদা জান্নাত নিশির হাজবেন্ড মিস্টার হামিদ, ওই গ্রুপের কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি বলেন এডমিনের বক্তব্য তিনি দিলেই হবে। তিনি অভিযোগকারীদের ঢালাও অভিযোগ অস্বীকার করেন, এবং বলেন তারা একটি মিট আপ ইভেন্টের আয়োজন করেছিলেন যাতে প্রায় দুই শত উদ্যোক্তা অংশগ্রহণ করেছিলেন, প্রায় ৪ লক্ষ টাকা খরচ হয় ওই ইভেন্টে। গ্রাহকদের সাথে প্রতারণায় অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালিও নাকি গ্রুপ অনুষ্ঠানে স্পন্সর করেছিলেন, সেখানে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক উদ্যোক্তার থেকেও খরচ দিয়েছেন তারা।
বিভিন্ন সেলিব্রিটিদের রিভিউ দেয়ার জন্য যাদের থেকে অর্থ গ্রহণ করেছেন তার মধ্যে অনেকের টাকা রিটার্ন করেছেন বলে তিনি স্বীকার করেন হানীফ এবং জানান যেসব সেলিব্রিটিদের রিভিউ দেয়ার সুযোগ না পাওয়ায় টাকা ফেরত দিয়েছেন।
কোন উদ্যোক্তা গ্রুপ কি করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিক্রি বাড়াতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার স্ত্রী এতটাই পপুলার কোনো পেইজের জন্য যে দুই লাইন লিখে দিলেই সেই উদ্যোক্তার অনেক টাকা বিক্রি হয়ে যায়।
কিছু ব্যক্তি তাদের গ্রুপের সুনাম নষ্টের জন্য এমন অভিযোগ করে যাচ্ছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :