বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকাঃ ঈদ মানেই উৎসব-আনন্দ। সেই আনন্দ ভাগাভাগি করতে প্রিয়জনদের কাছে ছুটে যান যান্ত্রিক শহরের বাসিন্দারা। কিন্তু প্রতিবারই এই আনন্দযাত্রা শুরু হয় সড়ক পথের ভোগান্তির মধ্য দিয়ে। যারা বাসে ওঠেন, তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকেন মহাসড়কে। আর যারা উঠবেন, কাউন্টারের সামনে বসে তাদের গুনতে হয় দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহর। ঈদে ঢাকা থেকে সড়ক পথে উত্তরাঞ্চলগামী যাত্রীদের বড় রকমের দুর্ভোগ পোহাতে হয় চন্দ্রা এলাকায়। এ পথে ভয়াবহ যানজট ও যাত্রীদুর্ভোগ কমাতে চালু হয়েছে উড়াল সড়ক। কিন্তু এতেও সমস্যার পুরোপুরি সমাধান মেলেনি। সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীরা বলছেন, এই অংশে আরও বেশি কাজ হওয়ার প্রয়োজন ছিল। ইন্টারসেকশন থেকে শুরু করে স্বল্পমেয়াদি আরও বেশ কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হলে উত্তরের পথের যাত্রীদের ঈদযাত্রা একেবারেই নিরাপদ করা সম্ভব হতো। আগামী ২২ এপ্রিল ঈদ ধরে ইতোমধ্যে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রির ঘোষণা এসেছে। নদীপথেও ঈদ ব্যবস্থাপনা চলছে একই দিন ধরে। কিন্তু সড়ক পথে এবার কী হবে, তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় ঘরমুখো মানুষ।
পরিবহন শ্রমিক ও সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর মিলিয়ে প্রায় ৭০ লাখেরও বেশি গার্মেন্ট শ্রমিক থাকেন। ঢাকা থেকে গ্রামে ফেরে কোটি মানুষের বেশি। নৌপথে যায় প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ। এবার পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় নৌপথে যাত্রী চাপ কমে সড়কে বাড়তে পারে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। ঈদ মৌসুমে এ বিপুল সংখ্যক মানুষের একযোগে বাড়ি ফেরায় সড়ক ব্যবস্থাপনায় যেমন রয়েছে ঘাটতি, তেমনি রয়েছে যানবাহন সংকট। সড়কের চলমান ডিজাইনও সেভাবে করা হয়নি। তবে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-মাওয়াসহ ফরিদপুর-খুলনা অঞ্চলে সড়কপথে নিরাপদে ঘরে ফেরার জন্য বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ঢাকা থেকে বের হওয়া ও প্রবেশ মুখগুলোকে কেন্দ্র করে স্বল্পমেয়াতি উদ্যোগ হিসেবে ইন্টারসেকশন নির্মাণের পরিকল্পনা করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। একেকটি মহাসড়কের বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে রয়েছে ইন্টারসেকশনগুলো। ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্পের আওতায় হওয়ায় এগুলোর নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি। একইভাবে শেষ হয়নি রাজধানীর চারপাশ ঘিরে ১৭২ কিলোমিটারের বিকল্প বৃত্তাকার পথের কাজও। ফলে এবারের ঈদযাত্রায় সড়কপথে ভোগান্তির শঙ্কা রয়েই গেছে। আসন্ন ঈদুল ফিতরের সরকারি ছুটি থাকবে তিন দিন। হিসাবে দেখা গেছে, ২২ এপ্রিল শনিবার। তাই ২১-২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি থাকার কথা। অর্থাৎ এবারের ঈদের বন্ধের আগে বা পরে শুক্র বা শনিবার না থাকায় ছুটি মাত্র তিন দিন থাকার সম্ভাবনাই বেশি। গতবার ঈদের বন্ধের সঙ্গে বাড়তি ছুটি থাকায় সড়কপথে ভোগান্তি ছাড়াই যাতায়াত করেছে মানুষ। তবে এবারের ঈদে হয়তো তা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ভোগান্তি কমাতে রেশনিং পদ্ধতিতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ছুটির পরামর্শ দিয়েছেন সড়ক বিভাগের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ঢাকা বিভাগ) সবুজ উদ্দিন খান বলেন, ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশ মুখগুলোকে কেন্দ্র করে ইন্টারসেকশনগুলোর কাজ দ্রুত শেষ হলে মানুষ অনেকটাই নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারত। এগুলো শেষ হতে আরও ছয় মাস লাগবে। তা ছাড়া ১২৩ কিলামিটারের বিকল্প সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ হতেও সময় লাগবে। যানজট নিরসনে ২০০৪ সালের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ছিল এই প্রস্তাব। ২০১৪ সালে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায়ও (আরএসটিপি) ঢাকা ঘিরে তিনটি বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। সেই আলোকে ২০২১ সালে যানজট নিরসনে রাজধানীকে ঘিরে তিনটি বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় সরকার। সেগুলো হলো আউটার রিং রোড, মিডেল রিং রোড ও ইনার রিং রোড। এর মধ্যে স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান ফর ঢাকার (আরএসটিপি) আওতায় রাজধানীর যানজট কমাতে পদ্মা সেতু থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বাইপাস হিসেবে রিং রোডের দক্ষিণ অংশের উন্নয়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সাভারের হেমায়েতপুর থেকে শুরু হয়ে কালাকান্দি-তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু, মদনপুর, ভুলতা হয়ে গাজীপুরের কড্ডা থেকে ঢাকা-ইপিজেড বাইপাইল দিয়ে হেমায়েতপুর পর্যন্ত হবে এই সড়ক। মোট সড়কের দৈর্ঘ্য ১৩২ কিলোমিটার। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আট লেনবিশিষ্ট এই সড়কের প্রস্থ হবে ২৪০ থেকে ৩০০ ফুট। এই অংশে দুটি রেস্ট এরিয়া, পাঁচটি ইন্টারচেঞ্জ, ছয়টি ব্রিজ, ২০টি ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া থাকবে নানামুখী সংযোগ সড়ক। এই সড়ক নির্মাণ হলে বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি হবে এবং শহরে গাড়ির চাপ কমে আসবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই প্রকল্পও দুই পর্বে ভাগ করে বাস্তবায়ন করার কথা। প্রথম পর্বে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে কেরানীগঞ্জের মদনপুর পর্যন্ত আট লেনের ৪৮ কিলোমিটার সড়ক হবে। বাকি ৩৬ কিলোমিটার অংশ জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। এজন্য ৩৮৪ হেক্টর জমির প্রয়োজন। আর দ্বিতীয় পর্বে ৮৪ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণ করা হবে।
প্রকল্পের পরিচালক সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান বলেন, নতুন ৩৬ কিলোমিটার সড়কটি জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় (জিটুজি) নির্মাণ করা হবে। এটি তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর সঙ্গে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। তবে এর সুফল পেতে আমাদের আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। এটি নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত এখন যে রুট গুলো আছে, সে গুলো দিয়েই যাতায়াত করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, পদ্মা সেতু চালুতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কেরানীগঞ্জ এলাকা দিয়ে আউটার রিং রোডের যে প্রস্তাবনা রয়েছে, সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে সেতুর কাঙ্ক্ষিত সুফল পাবেন না ঢাকাবাসী। তিনি বলেন, ঢাকাকে ঘিরে যতগুলো পরিকল্পনা করা হয়েছে, এগুলো ছাড়া যানজট কমানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আউটার রিং রোড হলে দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকামুখী মানুষ যার যার সুবিধামতো রিং রোড ব্যবহার করে চলে যেতে পারবেন। অন্যান্য এলাকার যাত্রীরাও একইভাবে রিং রোডের সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন। এতে ঢাকার যানজট অনেক কমে আসবে। বর্তমানে প্রতিদিন ৮ থেকে ১২ হাজার যানবাহন ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এই সংখ্যা প্রতিদিন আনুমানিক ২৫ হাজারে উন্নীত হয়েছে। ১০ বছরের মধ্যে তা ৪৫ হাজারে দাঁড়াবে। ইনার রিং রোড চালু হলে দেশের যে কোনো অঞ্চল থেকে আসা গাড়ি ঢাকা শহর এড়িয়ে যেতে পারবে। একই সুবিধা পাবে পদ্মা সেতুমুখী গাড়িগুলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তঃজেলা বাস আউটার রিং রোড অথবা বাইপাসের অভাবে ঢাকা শহরের ভেতরে যাতায়াত করে। ফলে শহরের মধ্যে জটলা তৈরি হয়। এ জন্যই প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ঢাকার পূর্ব-পশ্চিমের তুলনায় উত্তর-দক্ষিণে গাড়ির চাপ অনেক। তাই শহরের চারপাশে ইনার রিং রোড ও আউটার রিং রোড নির্মাণ রুট নির্ধারণ করা হয়েছে।
সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, যানজট নিরসনে এ ধরনের রিং রোড প্রকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ করে দেবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে যাত্রীরা গন্তব্যে যেতে পারবেন। তেমনি জ্বালানি খরচ কমবে।
আপনার মতামত লিখুন :