নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার: ঘুস ছাড়া কোনো কাজই হয় না বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কক্সবাজার জেলা অফিসে। অভিযোগ রয়েছে, মোটরযান নিবন্ধন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মালিকানা বদলি ও ফিটনেস নবায়ন করতে দালাল চক্র ও অফিস সহকারীদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা পরিশোধ না করলেই হয়রানির শেষ থাকে না গ্রাহকদের। ঘুসের টাকা ঠিকঠাক না পেলে ফাইলে ভুল আছে জানিয়ে ফেরত দেওয়া হয় কাগজপত্র। বিআরটিএ অফিসের নির্দিষ্ট দালালের মাধ্যমে কাজ না করলে ঘুরতে হয় মাসের পর মাস, পার হয় বছরও। আবার ঘুসের পরিমাণও নির্ধারণ করা হয় কাজের ধরনের ওপর নির্ভর করে। সেটা নির্ধারণ করেন পরিদর্শক আরিফুল ইসলাম। এ অফিসে অনিয়ম ও দুর্নীতি যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে এমনটাই অভিযোগ সেবা প্রত্যাশীদের।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কক্সবাজার বিআরটিএ অফিসের মোটরযান পরিদর্শক আরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী দালাল চক্র। যারা হরহামেশাই বিভিন্ন কাজ নিয়ে বিআরটিএ অফিসে ঘোরাঘুরি করে। আবার এই চক্রের সাথে রয়েছে গাড়ির শোরুমের কয়েকজন প্রতিনিধিও। যারা প্রতিদিন বিআরটিএ অফিসের সব অনিয়মকে ঘুসের বিনিময়ে নিয়মে পরিণত করে পরিদর্শক আরিফুল ইসলামের ইশারায়। তবে পরিদর্শক ঘুসের টাকা হাতে নয়, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নেন এমন তথ্য ওঠে এসেছে অনুসন্ধানে। এ টাকা গ্রহণ ও হিসাব রাখেন অফিস সহকারী নুরুল ইসলাম। সপ্তাহ শেষে হিসাব করে পদপদবি অনুযায়ী নগদ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের ভাগের টাকা বুঝিয়ে দেন। প্রত্যেক কাজের আলাদা আলাদা ব্যক্তি রয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিভিন্ন অনিয়মে জড়িত অফিস সহকারী নুরুল ইসলাম, ছাবেরসহ ১৫-২০ জনের একটি দালাল চক্র।
অনুসন্ধানে তার ডাচ-বাংলা ব্যাংকের কক্সবাজার শাখার নিজ নামীয় অ্যাকাউন্টের সন্ধান মেলে কক্সবাজার শাখার হিসাব নং-১৪৫১০১২৪৮৫২ কয়েক মাসের জমা স্লিপ প্রতিবেদকের হাতে আসে। এতে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে এক লাখ ৪৭ হাজার, এক লাখ ৪৬ হাজার, ৪৫ হাজার, দুই লাখ, ৫৫ হাজার, ৭৫ হাজার, তিন লাখ, দুই লাখ ৬৭ হাজার, এক লাখ ১০ হাজার ৫০০, ৬০ হাজার, ৬১ হাজার ৫০০, এক লাখ ৩১ হাজার ৫০০, ৪৮ হাজার ৫০০, ৬০ হাজার ৫০০ টাকাসহ সর্বমোট ১৩ লাখ সাত হাজার টাকা জমা করা হয়। অল্পসময়ে ব্যাংকে অবৈধ লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে সে অ্যাকাউন্টে লেনদেন করা বন্ধ করে দেন মোটরযান পরিদর্শক আরিফুল ইসলাম। তবে এক মাসে যদি ১৭ লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন হয় একজন পরিদর্শকের ব্যাংক হিসাবে তাহলে তিনি বিগত পাঁচ বছরে কত টাকা অবৈধভাবে আয় করেছেন সেটা হিসাব করলে দৃশ্যমান হবে।
আরিফুল ইসলাম বিআরটিএ কক্সবাজার সার্কেলে মোটরযান পরিদর্শক হিসাবে ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট যোগদান করেন। তার বাড়ি কক্সবাজার সদরে হওয়ায় তার নিজস্ব বলয় তৈরি করে দালালদের মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছেন সব অপকর্ম। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে চাকরি বদলি বিধিমালা না মেনে এক অফিসে কাটিয়ে দিচ্ছেন পাঁচ বছর। এ ছাড়া কক্সবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবৈধভাবে করা ঘুসের টাকায় গড়ে তুলেছেন এস এম পাড়ায় কোটি টাকা দামের আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি। একই এলাকায় কয়েক বিঘা দামি জমিও কিনেছেন। নামে বেনামে নিজের ও পরিবারের নামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। অভিযোগে জানা গেছে, শোরুমের প্রতিনিধিরা গাড়ির মালিকদের কাছ থেকে নিবন্ধনের ধার্য করা টাকা থেকে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা অতিরিক্ত ঘুস নিয়ে বিআরটিএ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। এ ক্ষেত্রে গাড়ির মালিকদের বিআরটিএতে গাড়ি না এলেও পাওয়া যায় রেজিস্ট্রেশন। আবার ঘুসের পরিমাণ একটু বাড়তি দিলে ফিটনেসেরও দরকার হয় না। গাড়ির চেসিস নম্বর, ইঞ্জিন নম্বর ও গাড়ির সিসি না দেখেই সব হয়। এ ক্ষেত্রে ঘুসের পরিমাণ বেশি লাগবেই। প্রতিদিন ২০-৩০টি গাড়ির ফিটনেস সনদ দিচ্ছে। আবার ঘুস দিলে গাড়ি পরীক্ষা ছাড়াই মেলে ফিটনেস সনদ। টাকা না দিলে গাড়ি দেখিয়ে ফাইল জমা দিয়ে মাস পেরিয়ে বছর ঘুরেও মেলে না ফিটনেস সনদ। প্রতিটি ফিটনেস সনদের জন্য প্রকারভেদে গুনতে হয় ৫-২০ হাজার টাকা। এই ঘুসের টাকার অর্ধেক একাই নেন মোটরযান পরিদর্শক আরিফুল ইসলাম। ফিটনেস নবায়ন ও মালিকানা পরিবর্তন শাখায় কাজ করেন অফিস সহকারী বেলাল, ফারুক, মাইনুদ্দিন। তবে এখানে ঘুস লেনদেন হয় বেলালের হাত হয়ে ফাইল চলে যায় সরাসরি মোটরযান পরিদর্শক আরিফুল ইসলামের কাছে। ঘুষ নেওয়া ফাইলের উপরে সাংকেতিক চিহ্ন দেওয়া থাকে। যেসব ফাইলে ঘুষ নেওয়ার সাংকেতিক চিহ্ন পাওয়া যায় সেটা দ্রুত কাজ করে দেন তিনি। টেকনাফ থেকে মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন করতে আসা ভুক্তভোগী জসিম নামের এক ব্যক্তি জানান, সরকারের নির্ধারিত ফি ব্যাংকে জমা দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছেন বিআরটিএ অফিসে। কিন্তু তারা কাগজপত্র গ্রহণ না করে তাদের নিয়োগকৃত দালাল বা শোরুমের সঙ্গে যোগাযোগ করে আবেদন করতে বলেন। পরে শোরুমে নির্ধারিত টাকার বাইরে ঘুস বাবদ পাঁচ হাজার অতিরিক্ত টাকা দিয়ে আবেদন করলে বিআরটিএ কাগজপত্র গ্রহণ করে এবং দ্রুত রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে দেন।
চকরিয়া থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে আসা খোরশেদ আলম জানান, আমি ও আমার বন্ধু সাকিব সরকারের নির্দিষ্ট ফি ও কাগজপত্র জমা দিয়ে লার্নার নিয়ে নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষা দিয়েছি। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় সবকিছু লিখার পরেও ফেল করেছি। পুনরায় পরীক্ষা আবেদন করে আবার ফেল করেছি দুজনে। পরে আমার বন্ধু অফিসের কর্মচারী নুরুল ইসলামকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে পরীক্ষা ছাড়াই পাশ করে লাইসেন্স পেয়ে যায়। আমি দুই বছর ঘুরেও লাইসেন্স পাচ্ছি না। কারণ নুরুল ইসলামের হাতে ঘুসের নগদ টাকা ছাড়া মেলে না ড্রাইভিং লাইসেন্স।
একজন দালাল জানান, বিআরটিএ অফিসের নির্দিষ্ট দালাল ও কর্মচারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষায় পাশের জন্য দিতে হয় ১০-১৫ হাজার টাকা। টাকা দিলে তারা লার্নারের উপরে একটি সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে থাকে। পরে চিহ্ন দেখিয়ে তাদের পাশ করিয়ে দেওয়া হয়। প্রতি বোর্ডে ৫০ থেকে ২০০ জন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। সেখানে ৭০-৮০ ভাগ পরীক্ষার্থী অংশ গ্রহণ করেন নুরুল ইসলাম ও অফিস সহকারী ছাবের মাধ্যমে ঘুস নেওয়া সাংকেতিক চিহ্ন যুক্ত পরীক্ষার্থী। প্রতিটা পরীক্ষা বোর্ডে উপস্থিত থাকেন মোটরযান পরিদর্শক আরিফুল ইসলাম। এ পরীক্ষায় প্রতিজন পাস বাবদ পেশাদার ও অপেশাদার প্রকারভেদে ৪-৮ হাজার টাকা করে চলে যায় আরিফুল ইসলামের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এবং বাকি টাকার ভাগ নেন দালাল ও কর্মচারীরা। কক্সবাজার বিআরটিএ সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক আরিফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমি কোনো ঘুস লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নই। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে জমা টাকার বিষয়ে বলেন, তার নিজের গ্যাসের দোকানের ব্যবসা আছে। চাকরির বাহিরে কি আমার ব্যবসা থাকতে পারে না? আলীশান বাড়ি, নিজের ও স্ত্রীর নামে এত জমি কিভাবে নিলেন-জানতে চাইলে বলেন, এসব আমার পৈতৃক জমি। আমার বিরুদ্ধে আনীত কোনো অভিযোগ সঠিক নয়। এ বিষয়ে জানতে চাইল কক্সবাজার বিআরটিএ সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে সরকারি ০১৫৫০০৫১৬৪৫ নম্বরে একাধিক বার যোগাযোগ করে কথা বলা সম্ভব হয়নি।